বই মেলা প্রসঙ্গ
দিল আফরোজ রিমা
ডেকেছ তুমি দু’ হাত বাড়িয়ে
সত্য জানাবে বলে
হৃদয়েতে তাই জ্ঞানের পিপাসা
উছলায় কূলে কূলে।
হ্যা, আমি বইয়ের কথাই বলছি। যার পাতায় চোখ বুলালে জ্ঞানের ও মনের পিপাসা মিটে। তবে আজ বই মেলা নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। মেলার মানেইতো মিলন। তাই মেলা মিলিয়ে দেয় মানুষে মানুষে, দেশে দেশে। এই মিলনের মাধ্যমেই আমরা চিনতে পারি মানুষ, দেশ, শিল্প, সংস্কৃতি ও সমাজকে। তবে মেলাতো নানা রকমের হয়। মেলা পন্যেরও হয় আবার জ্ঞান ভান্ডার আহরণেরও হয়। বই মেলার এক একটা ষ্টলে কত কত জ্ঞান ভান্ডার রয়েছে। ভাবলেই ভাল লাগে।
বই মেলার প্রচলন আগে ছিলনা। তবে সম্প্রতি তা নিয়ে প্রভুত উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষনীয়। ব্যপারটি বিশেষ তাৎপর্যপুর্ন বলেই বিদ্যোৎসাহীদের সন্ধানী দৃষ্টি এর উপরে নিবন্ধ।
১৮০২ সালে নিউইয়র্ক শহরে প্রথম বই মেলার আসর বসে। উদ্যোক্তা ছিলেন ম্যাথু কেরি। ১৮৭৫ সালে একশ জন প্রকাশক মিলে নিউয়র্কের ক্লিনটন শহরে আয়োজন করলেন বই মেলার। ত্রিশ হাজার গ্রন্থ্য এই মেলায় প্রদর্শিত হয়েছিল।
১৯৭৫ সালে মুক্তধারা নিজেদের উদ্যোগে বাংলাদেশে প্রথম বই মেলা চালু করে। বাংলা একাডেমী প্রাতিষ্ঠানিক বই মেলার আয়োজন করে ১৯৭৮ সাল থেকে। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ২১ তারিখে বাংলাভাষার জন্য আত্মউৎসর্গের যে বীরত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে, সেই স্মৃতিকে অম্লান রাখতেই ফেব্রুয়ারী মাসে বই মেলার আয়োজন করা হয় এবং বই মেলার নামকরণ করা হয় ‘ অমর একুশে গ্রন্থমেলা’।
১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারী চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণে বটতলায় একটুকরো চটের উপর ৩২টি বই সাজিয়ে বই মেলার গোড়া পত্তন করেন। এই ৩২টি বই ছিল চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্টিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমানে মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশী স্বরনার্থী লেখকদের লেখা বই। এই বইগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রথম অবদান। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত চিত্তরঞ্জন সাহা একাই বইমেলার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৬ সালে অন্যান্যরা অনুপ্রাণিত হন। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে বই মেলার সাথে সরাসরি সংস্পৃক্ত করেন।
১৯৭৯ সালে মেলার সাথে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। এই সংস্থাটি প্রতিষ্টা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৮৩ সালে কাজী মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির পরিচালক হিসাবে বাংলা একাডেমিতে প্রথম অমর একুশে বই মেলার আয়োজন সম্পন্ন করেন।
বই মানব সভ্যতার অন্যতম প্রাণস্বত্তা। বই মানুষে মানুষে প্রীতির বন্ধন দৃঢ় করে। বই আমাদের অতীত বর্তমান ভবিষ্যতের সেতু বন্ধন। আমাদের সুন্দর চিন্তার বিকাশ সাধনের চাবিকাঠি বই। গ্রন্থপাঠে মানুষের এক দুর্নিবার আকর্ষণ। এই আকর্ষনেই মানুষ ছুটে যায় বইমেলায়। বইমেলা পরিবার, সমাজ, দেশ সারা বিশ্বের অগ্রগতির হাতিয়ার। আর বইমেলা এক মহৎ অনুভবের প্রেরণা স্থল। যেখানে মানুষ এক অনাবিল আনন্দ অবগাহন করে।ভুলে যায় প্রতিদিনের জীবনের কষ্ট মালিন্য। আহরণ করে এক সুন্দর প্রাণশক্তি। বইমেলায় আছে এক অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ।
বইমেলা বইয়ের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বাড়ায়। মেলা শুরু হলে বই কেনার প্রতি বিশেষ তাগিদ অনুভব করি আমরা।
তাছাড়া দূর দূরান্ত থেকে বহু প্রকাশক আসেন বইমেলায়। আসে নানা ধরনের বই। অচেনা অজানা অনেক বইয়ের সন্ধান মেলে। ইচ্ছে অনুযায়ী সেগুলো কেনার সাধ্য হয় অনেকের। অন্তত মেলার সুবাদে কিছু বইয়ের সাথে ক্ষনিকের জন্য হলেও পরিচয় মেলে।
বই মেলাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন প্রকাশক একে অন্যের সাথে ভাব বিনিময়ের সুযোগ পান। বই প্রকাশ সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনারও অবকাশ পান। এছাড়া পাঠকদের চাহিদা সরাসরি লক্ষ করে নতুন নতুন বই প্রকাশের ক্ষেত্রে তারা তাদের কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে পারেন।
বই মেলায় নানা ধরনের প্রকাশক স্টল খুলেন। এক এক প্রতিষ্ঠান এক এক ধরনের বই পছন্দ করেন। ফলে ক্রেতারা তাদের অভিরুচি অনুযায়ী স্টল নির্বাচন করে বই কিনতে পারে। এছাড়া মেলা প্রাঙ্গণের সীমানায় অসংখ্য ধরনের বই পাওয়া যায় বলে ক্রেতাদের পক্ষে অল্প আয়াসে নিজ নিজ চাহিদা অনুযায়ী বই সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। বই মেলার সুরুচিসম্মত ও মনোরম পরিবেশ ক্রেতাদের সৌন্দর্য পিপাসাকে উদ্ধুদ্ধ করার মাধ্যমে বই কেনার ব্যাপারে উৎসাহ যোগায়। এছাড়া বই মেলায় বইয়ের মূল্যের দিক থেকে ক্রেতাদের কিছুটা কমিশন দেওয়া হয়।
মেলার বর্ণাঢ্য পরিবেশ বড়দের বই কেনার আগ্রহ যেমন বাড়িয়ে তুলে ছোটদের কল্পনাকেও তেমনই উজ্জীবিত করে। মেলা প্রাঙ্গণে লেখক ও প্রকাশকদের সমাবেশ ক্রেতাদের উৎসাহিত করে। বই মেলা বিখ্যাত লেখক ও প্রকাশকদের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের সুযোগ করে দেয়।
কর্মব্যস্ত মানুষ, যারা বই কিনতে যাওয়ার সময় পায় না তারাও অনেকেই বই মেলায় গিয়ে হাজির হয়। বইয়েই টানের সাথে বাড়তি যে জিনিসটি থাকে তা হলো মেলার টান। সেখানে শুধু নিজে গিয়েই তৃপ্তি নেই। আত্মিয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধব সবাইকে নিয়ে গিয়েও আনন্দ।
আমাদের জাতীয় মমনের প্রতীক বাংলা একাডেমির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এই মেলার সাথে একুশের জাতীয় চেতনা যুক্ত থাকে। বাংলা একাডেমির এই মেলা আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যে পরিনত হয়েছে। এছাড়াও একদল পাঠ্যানুরাগী প্রজন্ম গড়ে তুলতে এবং আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির লালন ও পৃষ্ঠপোষকতায় একুশের বই পালন করে আসছে অগ্রণী ভূমিকা। ফলে এই দিবসটি স্মরণ করে প্রকাশকরা নতুন নতুন প্রকাশনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। লেখক লেখিকাগন নব উদ্দীপনায় ও নতুন চেতনায় নতুন নতুন বই প্রকাশে হাত দেন। কেউ উপন্যাস, কেউ গল্প, কেউবা কবিতার বই লেখেন। আবার কেউ কেউ রচনা এবং প্রকাশনা দু কাজেই ব্যস্ত হন।
বইমেলার প্রাঙ্গণে বিচিত্র পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হতে হয়। মেলা চলাকালীন সময়ে প্রতিদিনই মেলাতে বিভিন্ন আলোচনা সভা, কবিতা পাঠের আসর বসে। প্রতি সন্ধায় থাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এছাড়া মেলাতে লেখক কুঞ্জ রয়েছে, যেখানে লেখকগণ উপস্থিত থাকেন এবং তাদের বইয়ের ব্যাপারে পাঠক ও দর্শকদের সাথে মত বিনিময় করেন। এছাড়া মেলার তথ্যকেন্দ্র থেকে প্রতিনিয়ত নতুন উম্মুচিত বইগুলোর নাম ও লেখকের নাম ঘোষণা করা হয়। দৈনিক প্রকাশিত বইয়ের সামগ্রিক তালিকা লিপিবদ্ধ করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন রেডিও টেলিভিশন চ্যানেল মেলার মিডিয়া হয়ে মেলার তাৎক্ষণিক খবরাখবর দর্শক শ্রোতাদেরকে অবহিত করে।
মেলার প্রাঙ্গণে মানুষের বিচিত্র পদচারণা লক্ষনীয়।কোথাও ইউনিফর্ম পড়া স্কুল কলেজের ছেলে মেয়েরা লাইন করে এগুচ্ছে, কোথাও আবার কোন প্রবীণ তার অনেক দিন আগেরকার কোন প্রীতিভাজনকে খুঁজে পেয়ে দু হাত বাড়িয়ে দেন, কোথাওবা বইয়ের প্যাকেট হাতে দ্রুত হেটে চলছে দোকানী কর্মচারী, কোথাও আবার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ নিয়ে মন্থরগতি জ্ঞানান্বেষী। কোথাও আবার চা, কফি, কোমল পানিয় খেতে খেতে বই প্রেমিকদের বিশ্রাম। এছাড়া বইয়ের বিভিন্ন স্টলেও নানা শ্রেণির মানুষ, কেউ প্রাণপণ চেষ্টায় ঠেলাঠেলি করে কাউন্টারের দিকে এগুতে ব্যাস্ত, কেউ সবার ভীর এরাবেন বলে স্টলের দরজায় দাঁড়িয়ে অন্যমনস্ক। কেই এক একটা বই হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে পাতা উল্টাচ্ছেন, কেউ বা সন্ধানী আলোর মতো চোখ বুলাচ্ছেন সাজিয়ে রাখা বইগুলোর উপর। কেউ দেখছেন অনেক, কিনছেন সামান্য। কেউ আবার ঝোঁকের মাথায় না দেখেই অনেক কিছু কিনে ফেলছেন।
মানুষের মধ্যে বই পড়ার প্রবনতা বাড়াতে হবে। পড়ার অভ্যাসে বই কেনার অভ্যাস গড়ে উঠবে। বই মেলা সার্থক হবে। বিগত কয়েক বছরে আমাদের দেশে বইমেলার জনপ্রিয়তা অনেকটা বেড়েছে। বাংলা একাডেমি আয়োজিত গত কয়েক বছরের বই মেলাই তার প্রমাণ। প্রতি বছর এখানে ক্রেতা ও বইয়ের স্টলের সংখ্যা বাড়ছে। তরুণ প্রজন্মদের বইমেলার প্রতি আগ্রহী করে তুলা আমাদের কর্তব্য। তাদের বই মেলায় নিয়ে গেলে মেলার উদার উম্মুক্ত পরিবেশে তারা মুক্তির খুজ করবে। বিভিন্ন বইয়ের স্টলে নানা ধরনের প্রচুর বই দেখে তারা আনন্দে আত্মহারা হবে।
এবারও হবে আমাদের প্রাণের বইমেলা। সবাইকে আহবান জানাই, আসছে বইমেলা চলুন মেলায় হাজারো বইয়ের মাঝে প্রাণের খুঁজ করি।
দিল আফরোজ রিমা, কবি,লেখক ও সাহিত্যিক