– কীরে কতদিন পর তোকে দেখলাম! কেমন আছিস তুই? ভাগ্যিস এক্সাম দিতে এসেছিলি! নাহলে তো তোর দেখাই পেতাম নারে, বিয়ের পর সেই যে নিখোঁজ হয়ে গেলি। তা অনেক বেশি ব্যস্ত থাকিস বুঝি?
মিশুর সাথে দেখা হবার সাথে সাথেই একসাথে এতগুলো কথা শুনে খানিকটা অস্বস্তিতে ভোগে ইলা। মুখে শুকনো হাসি হেসে বলে,
– নারে, আসলে কী আর বলবো বল! বাদ দে। চল সামনের ক্যাফেটেরিয়ায় গিয়ে বসি। কফি খেতে খেতে গল্প করা যাবে।
খাবারের অর্ডার দিয়ে চেয়ারে বসতে না বসতেই ইলার চোখ পড়ে কিছুদূরে বসে থাকা লোকটার উপর। আরে! ইনি তো প্রায়ই ইলার শ্বশুর বাড়িতে যাতায়াত করে। মাঝে মাঝেই বাজার করে দেয়। উনি এখানে কেন? তার মানে নিশ্চয়ই ইলার পেছনে স্পাই লাগিয়েছেন ওর শ্বশুর বাড়ির লোকেরা। মুহূর্তেই মেজাজ বিগড়ে যায়। এভাবে আর কত?
গলার স্বর কিছুটা নিচু করে মিশুর সাথে কথা শুরু করে ইলা।
– মেয়েদের জীবনটা এমন কেন বলতো?
– কেন কী হয়েছে রে? এনিথিং রং? তুই ঠিক আছিস তো?
– কিভাবে ঠিক থাকবো বল? শ্বশুর বাড়ির লোকেরা আমায় সন্দেহ করে। বিয়ের পর শামীম তো কানাডায় চলে গেল। সেও কারণ ছাড়া আমাকে সন্দেহ করে। কারোর কল রিসিভ করতে গেলেও ভয়ে ভয়ে থাকি। সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকতে কার ভালো লাগে বল?
– তোর বাসায় জানাসনি? এখনও ঐ বাসায় পড়ে আছিস কেন?
– বাসায় জানিয়েও কোনো লাভ হয়নি। মায়ের এক কথা, মানিয়ে নাও। সব সংসারেই কমবেশি ঝামেলা থাকে। তাছাড়া বিয়ের পর বাবার বাড়িতে থাকলে পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজনরা কী ভাববে?
এর মাঝেই খাবার চলে আসে। বেশিক্ষণ কথা হয় না মিশুর সাথে। বেশি দেরি হলে আবারও কৈফিয়ত দিতে হবে। তাছাড়া কিছুক্ষণ পর পর লোকটার চাহুনিতে আরও অস্বস্তিবোধ কাজ করে।
শ্বশুর বাড়ি ফেরার সময় সারারাস্তা ইলা ভাবতে থাকে, যে বিয়ের জন্য এতটা মরিয়া হয়েছিল, সেই বিয়ে হবার পর নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে জানলে কোনদিন বিয়ে করতে চাইতো না সে।
একদিন বিদেশ ফেরত স্বামীর হাতে সত্যি সত্যি খুন হয় ইলা।
আমাদের সমাজে অসংখ্য ইলা আছে যারা মৃত্যুর আগেই বহুবার মরে। মরার পর বাবার বাড়ির লোকেরা বিচার চায়। কিন্তু আদৌ কি কোনো লাভ হয়?
আজও এই সমাজে বিয়ের পর মেয়েদের পরিবার ভাবেন, বিয়ে দিয়েই তাদের সমস্ত দায়িত্ব পালন শেষ। শারীরিক নির্যাতন তো দেখা যায় কিন্তু মানসিক নির্যাতন? কন্যাসন্তান কি আসলেই বোঝা?
এ তো গেল এক কাহিনী, বিয়ের পরবর্তী কতজন মেয়ে পুরোপুরি বাবার পরিবারের সাপোর্ট পায়? বাবা-মায়ের মতো আপন পৃথিবীতে কেউ নেই মানলাম,কিন্তু সেটা কি শুধুই বিয়ের আগে?
হয়তো সব মেয়ের পরিবার এক নয় কিন্তু বেশিরভাগ মেয়ের বিয়ের পর মানসিক নির্যাতনগুলো কেউ অনুভব করে না। মেয়েটা ভেতরে ভেতরে তিলে তিলে নিঃশেষ হয়। কেউ কেউ প্রাণ হারায়। অথচ বেঁচে থাকা অবস্থায় মেয়েটাকে কেউ বোঝারই চেষ্টা করে না।
আহারে জীবন! জন্মের পর থেকে একটা মেয়েকে এত এত বাঁধার সম্মুখীন হয়ে টিকে থাকার জন্য লড়াই করতে হয়। ভাগ্যবতীরা কপাল গুণে ভালো জীবনসঙ্গী পায় আর যারা পায় না তারা বারবার মরে।
বিজয় দিবসের সুবর্ণজয়ন্তী আজ। অথচ মন মানসিকতার দিক থেকে এখনও কতটা পিছিয়ে আছি আমরা! মেয়েদেরকে বোঝা মনে না করে একজন মানুষ হিসেবে ভাবুন। তাদেরকে এভাবে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দেবেন না। মৃত্যুর পর বিচার না চেয়ে মৃত্যুর আগেই তার জীবনকে সুরক্ষিত করার চেষ্টা করুন।
কানিজ ফাতেমা সোমা- সাহিত্যিক ও সাহিত্য সমালোচক।