কখনো কখনো ছোট্ট একটি ঘটনাও অনেক বড় শিক্ষা দিয়ে যায়। রহিমা খালার ব্যাপারটিও আমার জন্যে চরম শিক্ষনীয় হয়ে থাকলো।
আমি আজ এক যুগ ধরে প্রতিদিন সূরা ওয়াকিয়া পড়ি। এটি আমার ভীষণ প্রিয় সূরা। এর তিন নম্বর আয়াতে কেয়ামত দিবস সম্পর্কে বলা হয়েছে, “তা (কেয়ামত দিবস) হবে উলট-পালোটকারি মহা প্রলয়”।
আমি প্রতিটি আয়াত নিয়ে একটু ভাবার চেষ্টা করি। এই আয়াত সম্পর্কে আমার চিন্তার ফল ছিলো, আমি মনে করতাম এই উলোট-পালোট বলতে প্রকৃতির কথা বলা হয়েছে। আকাশ-পাহাড়-সমুদ্র সব উল্টা-পাল্টা হয়ে মিলে মিশে যাবে এটাই ভাবতাম। যেমন করে সূরা যিলযালে বলা হয়েছে – পাহাড় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে, আকাশ ভেঙে বইয়ের পাতার মতো উড়তে থাকবে, সাগরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হবে……
এই উলোটপালোটকারীর ব্যাখ্যা আমার এভাবেই জানা ছিলো। একদিন হঠাৎ একটি তাফসীরে এর অন্য একটি ব্যাখ্যা পেয়ে থমকে গিয়েছিলাম। নতুন চিন্তার খোরাকও পেয়েছিলাম সেদিন।
তাফসীরে যা লেখা আছে তার ভাবার্থ হলো, ” ওরকম তো হবেই। আকাশ-পাহাড়-সমুদ্র তো উল্টা-পাল্টা হবেই, আরো একটি জিনিস উল্টা-পাল্টা হবে তা হলো মানুষের স্ট্যাটাস৷”
তাফসীরের এই ব্যাখ্যাটি নিয়ে ভাবতে গিয়ে মনে হলো, “হ্যাঁ, তাইই তো। সেদিন তো সত্যিই স্ট্যাটাস চেঞ্জ হয়ে যাবে। মানুষের আমলের কারণে উচুঁ পদের লোকেরা হয়তো পদদলিত হবেন, নিচুঁ পর্যায়ের লোকেরা চলে যাবেন উর্ধ্বে। প্রেসিডেন্টের অফিসের ক্লিনার হয়তো সম্মানিত হবেন আর স্বয়ং প্রেসিডেন্ট হবে লজ্জিত।”
এই ব্যাখাটির পর থেকে বারবার মহান রবের কাছে ইহকাল এবং পরকালের সম্মানের জন্য দোয়া করি।
থাক সেসব কথা। রহিমা খালার কথা বলি।
আমাদের অফিসে যে খালা রান্না করেন, আমি খেয়াল করে দেখেছি উনি কখনো অফিসে খান না। খাবারটা নিয়ে যান। জিজ্ঞেস করলে উনি বলেন, “বাসায় গিয়ে গোসল সেরে তারপর খাই।”
গত পরশু খালা অসুস্থ হয়ে রান্না করতে আসতে পারেননি। বিকেলবেলা অফিসের চাপ কমলে তার বাসায় গেলাম খোঁজ নিতে। অনেক কথা হলো। কথার মাঝেই অফিসে না খাওয়ার রহস্য উদঘাটিত হলো।
খালার একজন বৃদ্ধা প্রতিবেশী আছেন। নাম রহিমা। আগে অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন। এখন বয়সের কারণে আর কাজ করতে পারেন না। তার কোন আয় নেই। খালা অফিসের খাবার বাসায় নিয়ে এসে রহিমা খালার সাথে ভাগাভাগি করে খান।
রহিমা খালার খাবার তেমন লাগে না। উনি সপ্তাহে দুইদিন রোজা থাকেন। সোমবার এবং বৃহস্পতিবার। ফজরের নামাজের পর দীর্ঘ সময় কোরআন তেলাওয়াল করেন। বাসায় তিনটি মুরগী আছে। এই মুরগীই তার সম্পদ।
খালাকে সাথে নিয়ে আমরা রহিমা খালার বাসায় গেলাম। ছোট্ট একটু জায়গার উপর চারিদিকে ঘেরা বাড়ি। একটা রুম। একটা রান্না ঘর। পাশে খড়ি রাখার জন্য আরেকটি ছোট ঘর।
বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। উদ্দেশ্য ছিলো খালাকে কিছু ডিম দেওয়ার মতো হাঁস-মুরগী কিনে দিবো। কোথায় রাখা যায়, সেটাই দেখছিলাম। হঠাৎ করেই চোখ গেল খড়ি ঘরের দিকে। খড়ি নেই। মেঝেতে খেজুর পাতার মাদুর পাড়া।
রহিমা খালাকে জিজ্ঞেস করলাম, “খালা এখানে কে থাকেন?”
খালা বললেন, “বাবা এখানে একজন বিধবা মহিলা থাকে।”
-আপনার কেউ হয়?
-না।
-তাহলে কি উনাকে ভাড়া দিয়েছেন?
-না।
-তাহলে?
-মহিলাটির কেউ নেই। অন্যের বাসায় কাজ করে। থাকার জায়গা নেই। তাই আমার ঘরটা ওকে দিয়েছি। বাইরে বাইরে কাজ করে। রাতে এসে এখানে ঘুমায়।
-আপনাকে কোনভাবে সাহায্য করে?
-না বাবা। মেয়েটার নিজেরই চলে না। আমাকে সাহায্য করবে কিভাবে।
আমি স্তম্ভিত হয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। সূরা ওয়াকিয়ার তিন নম্বর আয়াতটির সেই ব্যাখ্যাটি মনে পড়লো। উচুঁ-নিচুঁ উলোটপালোট হয়ে যাবে। আমরা যারা আজ সম্মানিত, তারা কেয়ামতের দিন কোন পর্যায়ে যাবো জানি না। আমাদের কাজের খালা, নিজের খাবার থেকে দুনিয়ায় কেউ না থাকা রহিমা খালাকে খাবার দেওয়ার জন্যে কি মর্যাদাবান হবেন! রহিমা খালা কি গৃহহীন সেই বিধবাকে নিজের ঘরের ভাগ দেওয়ার কারণে মর্যাদাবান হবেন!
এখনও রোজ সকালে ওয়াকিয়া পড়ি। তিন নম্বর আয়াতে গিয়েই আটকে যাই।
হে পরওয়ারদিগার, আমাদের প্রতি সহায় হোন। এপার-ওপার দু’জায়গাতেই সম্মানিত করেন মাবুদ।
আসাদুজ্জামান জুয়েল – সাহিত্যিক,গল্পকার ও উপন্যাসিক।