Take a fresh look at your lifestyle.

কালো মেয়ের গল্প

827

 

শ্যামলা বরণ মুখটি ভারী মিষ্টি। নিজের গায়ের রঙ কালো বলে কোন আফসোস বা মাথাব্যথা নেই জুবাইদার। যে রংটি স্বয়ং আল্লাহ তার জন্য পছন্দ করেছেন তা সে কখনো অপছন্দ করে না। তবে স্বামীর কাছ থেকে কালো রংটির জন্য অনেক কথা শুনতে হয় তার। সেজন্য স্বামীকেও কোন দোষ দেয় না সে। কালো স্ত্রী স্বামীর পছন্দ নাই হতে পারে। শুধু মাঝে মাঝে মনে হয়, বিয়ের আগেওতো কালো মেয়েটাকে স্বামী দেখেছিল। তাহলে দেখে শুনে এমন অপছন্দের মানুষকে বিয়ে না করলেইতো ভালো হতো।
স্বামী সাইফুদ্দীনের অবহেলা আর খারাপ আচরণ সহ্য করে দিন চলছে জুবাইদার। ইতিমধ্যে বাবার কাছ থেকে পাওয়া জুবাইদার বেশ কিছু জমি সাইফুদ্দীন নিজের নামে লিখে নিয়েছে। জুবাইদা নির্দিধায় লিখে দিয়েছে। জমিগুলো দিয়ে দেবার পর থেকেই স্বামীর খারাপ ব্যবহার আরো বেড়ে গেছে। তাকে দু’চোখে দেখতে পারে না। সব সময় এত খারাপ ব্যাবহার করে যাতে জুবাইদা অতিষ্ট হয়ে নিজেই বাড়ি থেকে চলে যায়।
অত্যাচারের সীমা ছাড়িয়ে গায়ে হাত তুলতে শুরু করেছে। এমত অবস্থায় এক সময় মনে হয় মা বাবা নেই। ছেলে মেয়েও নেই। স্বামী দু’ চোখে দেখতে পারে না। শুধু সম্পত্তি আগলে বসে থেকে কি হবে? তারচেয়ে চলে যাই এই খারাপ পৃথিবী ছেড়ে। কত মানুষইতো আত্মহত্যা করে।
কিন্তু এ কথা ভাবার পর নিজেই আর একটি ভাবনায় পড়ে যায়। আসলে জুবাইদা খুব প্রত্যয়ী এবং ধৈর্য শীলা। এমন ভাবনাটা একমাত্র শয়তানই মনের মধ্যে এনে দেয়। জুবাইদা শয়তানকে মনের মধ্যে বেশিক্ষণ জায়গা দেয়নি। সে ভাবে ‘ না, এ হতে পারে না। আত্মহত্যা মহাপাপ। অস্থায়ী জীবনের কথা ভেবে আমি আমার স্থায়ী জীবনটা জাহান্নামে কাটাতে চাই না। তাছাড়া এটা কোন সমাধান নয়। অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে নিজে জীবন থেকে পালিয়ে যেতে আমি পারব না। এটা কোন বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না। আমাকে সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। ‘
এভাবে চলে আরো কিছু সময়।
এক সময় গ্রামের এক ধনী ব্যাবসায়ীর মেয়ে মমতাজের সাথে সাইফুদ্দীনের আলাপ পরিচয় এবং ভাব জমে উঠে। তারপর সাইফুদ্দীন মমতাজকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়। মমতাজ তাকে শর্ত দেয়, জুবাইদাকে তালাক দিলে সে বিয়েতে রাজি হবে। সাইফুদ্দীন ভাবে, জুবাইদাকে তালাক দিলে অনেক ঝামেলা হতে পারে। মোহরআনার এত টাকা সে কিছুতেই দিবে না। তার চেয়ে ভাল হয় ওকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে পারলে। সে মনে মনে ভাবে জুবাইদার সব জমি এখন তার। মমতাজও বিশাল ব্যাবসায়ীর একমাত্র সন্তান। বাবার কোটি কোটি টাকার মালিকতো সেই হবে। তাই মমতাজকে হাতছাড়া করলে চলবে না। এখন জুবাইদা ঝামেলাটাকে কিভাবে পৃথিবী থেকে বিদায় করা যায় সেটাই ভাবতে হবে।

পরের দিন সে গ্রামের এক দরিদ্র লোক রহিমের বাড়িতে যায়। তাকে না পেয়ে তার স্ত্রীর কাছে বলে আসে, রহিম যেন আমার বাড়িতে গিয়ে দেখা করে। তার জন্য অনেক টাকার একটি কাজ পাওয়া গেছে।
বিকেলে রহিম খুশি হয়ে সাইফুদ্দীনের সাথে দেখা করতে যায়। ড্রইং রুমে বসে খুব আস্তে আস্তে কথা বলার ব্যাপারটা জুবাইদা বুঝতে পারে। তাই রুমের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সে সব কথা শুনে এবং মোবাইলে রেকর্ড করে।
সাইফুদ্দিন রহিমকে যে কাজ করতে বলে তা করতে রহিম প্রথমে অস্বীকার করলেও অনেক টাকার লোভে রাজি হয়। রহিম চলে যায়। পরের দিন রাত চারটায় এই বাড়িতে তার কাজ।

সাইফুদ্দীন মনে মনে হাসে আর ভাবে, রহিমকে আমি একটি টাকাও দেব না বরং হত্যার দায়ে তাকে পুলিশে ধরিয়ে দেব।

এদিকে জুবাইদা মন খারাপকে প্রশ্রয় না দিয়ে শক্ত হাতে মুকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত হয়। জুবাইদা ধার্মিক, মহানোভব, উদার কিন্তু বোকা নয়। সে খুব বুদ্ধিমতী এবং যোগ্য। স্বামীকে তার সকল সম্পত্তি লিখে দিয়েছে বলে বোকামি করেছে? তা নয়। সে ইচ্ছে করেই স্বামীর আবদার পূরণ করেছে। যাহোক জুবাইদার কথাই বলছিলাম। সে উচ্চ শিক্ষিতা, আত্মরক্ষার কৌশল জানে, ড্রাইভিং জানে, সাতার জানে, আধুনিক প্রযুক্তির প্রায় সকল কাজের সাথে সে সুপরিচিত।
কিন্তু সে খুব নরম মনের। চাল চলনেও খুব কোমল এবং লাজুক। মনে কোন অহংকার নেই এমনই খুব সাধারণ একটি মেয়ে। সে যে এতটা যোগ্য তাকে দেখলে বুঝা যায় না। তাই সাইফুদ্দীনও তাকে ভালো ভাবে জানে না।

পরের দিন জুবাইদা প্রতিদিনের মত সারে তিনটায় ঘুম থেকে উঠে অজু করে তাহাজ্জুত পড়তে বসে। নামাজ পড়া শেষ করে জায়নামাযে বসে বুঝতে পারে তার পিছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। জুবাইদা ঝড়ের গতিতে উঠে দাঁড়ায় এবং জোরসে একটি ঘুশি গিয়ে লাগে রহিমের বুকে। রহিম সাথে সাথেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। তার হাত থেকে খসে পড়ে ধারালো দা। জুবাইদা এবার রহিম আলীকে ভালো করে বেঁধে রাখে যাতে তার জ্ঞান ফিরলে পালাতে না পারে। আর কোন সময় নষ্ট না করে মাথা ঠান্ডা করে সে আবার জায়নামাজে বসে।
যথা সময়ে আজান হয়। ফজর পড়ে ওয়াজিফা পড়তে থাকে জুবাইদা। এমন সময় সাইফুদ্দীন চুপি চুপি এসে রহিমের কাছে বসে। এর মধ্যে রহিমের জ্ঞান ফিরেছে। দু’জনের ফিসফিসানি শুনতে পায় জুবাইদা। সে জানে উরা পালাতে পারবে না। কারন, অসৎ লোকেরা ভিতু আর কাপুরুষ হয়। এদের সাহস থাকে না। সে মোনাজাত শেষ করে জায়নামাজটি ভাজ করে জায়গামত রাখে। তারপর স্বামীকে বলে, খবরদার তুমি ওর বাঁধন খুলবে না। চলে যাও এখান থেকে।

সাইফুদ্দীন কোনদিন জুবাইদাকে এমন করে কথা বলতে শুনেনি। সে ভয় পেয়ে গেল। সেতো জানেইনা তার স্ত্রী যে কম্ফু আর কারাতে ব্ল্যাক বেল্ট পাওয়া একজন সৎ সাহসী মেয়ে। কি করবে বুঝতে না পেরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

জুবাইদা আর দেরি না করে পুলিশকে ফোন করল। কাছেই পুলিশ ষ্টেশন। দশ মিনিটের মধ্যে পুলিশ এসে হাজির। জুবাইদা ঘরের তিনটি জায়গা থেকে তিনটি ছোট ছোট স্পাই ক্যামেরা বের করল এবং সেগুলি পুলিশের হাতে তুলে দিল। আর তার নিজের মোবাইল ফোনে সাইফুদ্দীনের সাথে রহিমের রেকর্ড করা কথাগুলো জুবাইদা পুলিশকে শুনিয়ে দিল। দু’জনকেই ধরে নিয়ে গেল পুলিশ।

মামলা হলো। বিচার হলো। দু’জনেরই যাবৎ জীবন কারাদণ্ড হলো।

ক’দিন পর জুবাইদা স্বামীর সাথে দেখা করতে যায়। তখন সাইফুদ্দীন তাকে বলল, আমি খুব লোভ করেছিলাম তাই আজ আমার এই অবস্থা। তুমি একদিন আমাকে বলেছিলে, বেশি লোভ করা ভাল নয়। আরো বলেছিলে, লোভে পাপ আর পাপে মৃত্যু। কিন্তু আমি সে কথায় কান দেইনি। তোমার সবকিছু নিয়ে তোমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম। আমি কেন এত খারাপ বলতে পার?

জুবাইদা শান্ত কন্ঠে বলে, আমার ধারণা তুমি
একদিন ঠিকই ভালো হয়ে যাবে।

কথাটি বলে সে চলে আসে। স্বামী জেলে যাবার পর সে স্বামীর ঘর থেকে বাবার বাড়ি চলে যায়। একটি কলেজে শিক্ষকতা শুরু করে।

জেল খানায় সাইফুদ্দীনের তিন মাস কেটে গেল। জুবাইদা ভাবল, এবার ক্ষমা করে দেওয়া উচিত। সে উকিলের সাথে কথা বলে জেলখানা থেকে সাইফুদ্দিন এবং রহিমকে বের করার ব্যবস্থা করে আসে। ওদিকে যে রহিম টাকার লোভে তাকে মারতে গিয়েছিল। তার পরিবারের করুন অবস্থায় জুবাইদা নিজে তাদের সাহায্য করেছে।

সাইফুদ্দীন জেল থেকে বের হলে কে তার মুক্তির ব্যাবস্থা করল তা না জানলেও সে ধরেই নিয়েছে এ কাজ তার স্ত্রীই করেছে। সে নিজের বাড়িতে না গিয়ে সোজা শ্বশুর বাড়িতে জুবাইদার কাছে চলে যায়। তার কাছে মাফ চেয়ে তার কাছ থেকে নেওয়া সমস্ত সম্পত্তি ফিরিয়ে দিবার অঙ্গিকার করে।
কিন্তু জুবাইদা বলে, আমি তোমাকে আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি। আর আমি সম্পত্তি দিয়ে কি করব। আমি যা দেই তা কখনো ফিরিয়ে নেই না। তাই সম্পত্তি ফিরিয়ে দেবার কোন প্রশ্নই আসে না। তুমি এবার তোমার পছন্দমতো বিয়ে করে সুখী হও। কখনো লোভ করোনা। হত্যা করা মহা পাপ তাই ওসবের ধারে কাছেও যেও না।

জুবাইদা আমাকে যদি মাফ করে থাক তাহলে বাড়ি চলো। আমি আর এমন ভুল কোনদিন করব না। আমি একজন ভালো মানুষ হতে চাই। তুমি যদি আমার পাশে থেকে আমাকে পথ দেখাও তাহলে আমি পারব। আমাকে ফিরিয়ে দিও না। আমাকে একটি বার ভাল হতে সুযোগ দাও।

 

দিল আফরোজ রিমা- কবি ও সাহিত্যিক।

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.