আমি নিরুপমা রায়। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। মেয়েদের ক্ষেত্রে বিয়ের আগে বয়স লুকাতে হয়। নিজের বয়স যখন বলেছি তখন ধরে নিতে পারেন আমি দ্বিতীয় বাড়িতে অবস্থান করছি। এই বাড়িতে আছি এক বছর ধরে। আমার নামের পাশের পদবিটা এখন পাল্টেছে। এখন আমি নিরুপমা চৌধুরী। ছোটবেলা থেকে যে বাড়িতে আমি থাকতাম সেটা ছিল আমার প্রথম বাড়ি। একটা একান্নবর্তী পরিবারে আমি বড় হয়েছি। দাদু, ঠাকুমা, কাকা, কাকিমা, কাকাতো ভাইবোন, পিসি সবাই মিলে অনেক বড় পরিবার। একেবারে হৈ-হুল্লুড়ে দিন কাটত। কিছু হলে ঠাকুমা, কাকিমাদের বলতে শুনতাম বাপের বাড়িতে আছিস তো তাই বুঝতে পারছিস না ও বাড়িতে গেলে বুঝতে পারবি। তখন বুঝেছিলাম বাবার বাড়ি মেয়েদের প্রথম বাড়ি। আর এখন এটা আমার দ্বিতীয় বাড়ি। এতক্ষণে বুঝে গেছেন একজন মেয়ের দ্বিতীয় বাড়ি তার স্বামীর বাড়ি। ভবিষ্যতে আমার আরো একটা বাড়িতে থাকতে হবে সেটা হল আমার ছেলের বাড়ি।
কপাল মন্দ হলে চতুর্থ বাড়ির দেখাও পেয়ে যেতে পারি। আর সেটা হল বৃদ্ধাশ্রম। ছোটবেলায় কারো সাথে ঝগড়া হলে বলতাম আমার বাড়ি থেকে চলে যাও। তখন জানতাম না আমার কোন বাড়ি ছিল না। বাবার বাড়িকে আমি নিজের বাড়ি ভাবতাম। বাবার, স্বামীর, ছেলের বাড়ি কি আসলে কখনো মেয়েদের নিজের বাড়ি হয়? এখন আর কোন বাড়িকে নিজের বাড়ি বলি না। মেয়েদের নিজের বাড়ি নেই।আমার এক কাকিমার কোন ছেলেসন্তান নেই। কাকাতো বোনদের দেখে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে অনেককে বলতে শুনেছি বাবার বংশে বাতি জ্বালাবে কে, মেয়ে দুটোকে বিয়ে দিয়ে দিলে? ছোট থেকে দেখেছি বাড়িতে সাঁঝের বেলা তুলসীতলা থেকে শুরু করে ঠাকুর দেবতার মন্দির, শয়নকক্ষ আলোকিত করত আমার মা, কাকিমা, ঠাকুমা। আমার বাবা, কাকা, দাদু কাউকে বাতি জ্বালাতে দেখি নি কখনো। সকল মাঙ্গলিক কাজে মেয়েদের প্রদীপ জ্বালাতে দেখেছি। পুরুষরাও জ্বালায়। তবে সচরাচর দেখিনা। আমার শ্বশুরবাড়িতে আমিই আলো জ্বালানোর কাজটি করি। ছেলেকে বিয়ে দিয়ে অন্য পরিবার থেকে একজন নারী এসে বাতি জ্বালালে বংশ রক্ষা হয়। কোন মেয়ে যদি বাপের বাড়িতে বিয়ের পর থেকে বাতি জ্বালায় কিংবা তার মেয়ে বাতি জ্বালায় সেক্ষেত্রে বংশ রক্ষা হয় না। এটাই সমাজবিধি। একজন সন্তানের শরীরে তার পিতার রক্ত প্রবাহিত হয়। আর দশ মাস মায়ের রক্ত, মাংস শুষে নিয়ে সন্তান পরিপুষ্ট হয়ে ভূমিষ্ট হলেও মায়ের পদবি ঐ সন্তান ধারন করতে পারবে না। আসলে মায়ের তো কোন পদবি নেই। সেই পদবি তো তার পিতার কিংবা স্বামীর। বংশ পরম্পরায় যে নারীরা বাতি জ্বালানোর কাজটি করে আসছে তারাই নাকি নিজের বংশে বাতি দিতে পারে না। বাবার বাড়িতে আমি সেলাইয়ের কাজ শিখেছিলাম। বাইরে কোন কাজ করি না তাই টুকটাক সেলাইয়ের কাজ করি। কয়েকদিন ধরে অর্ডারটা বেড়েছে। তাই আমার স্বপ্নও বড় হচ্ছে। নিজের খরচের পরে কিছু টাকা হাতে থাকছে। ভাবছি অল্প অল্প করে এই টাকাগুলো জমা রাখব। আর এই টাকা সন্তানের জন্য ব্যয় করব না। নিজের নামে একটা জমি কিনব। সেখানে একটা বাড়ি করব। আর বাড়ির নাম দিব ‘নিরুপমা স্বপ্ন নিকেতন’। সবুজ অক্ষরে নামটি শান্তির আশ্রয়ের বার্তা দিবে। সন্তানরা একদিন বলবে আমার মায়ের বাড়ি। আমার মেয়ে, তার মেয়ে, তার মেয়ে সাঁঝের বেলা বাতি জ্বালাবে। আমার মৃত্যুর পর আমার বাড়ির পাশে আমাকে দাহ করা হবে। বাবার, স্বামীর কিংবা ছেলের বাড়িতে নয় আমার নিজের বাড়িতে আমি চিরনিদ্রায় ঘুমাব। এই বাড়ি দেখে আমার মত নারীরা যাদের নিজের কোন বাড়ি নেই তারা স্বপ্ন দেখবে নিজের একটি বাড়ি করার। নারীরা উপলব্ধি করতে পারবে তাদের নিজের একটা বাড়ি থাকা দরকার। আমার বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কোন নারী বলবে নিরুপমার মত আমিও একটা বাড়ি করব। সেদিন আমার স্বপ্ন নিকেতনের স্বপ্ন পূরণ হবে।
শ্রবস্তী শুচি –
কবি ও সাহিত্যিক ।