আজ থেকে পচিঁশ বছর আগে আমি মাত্র কলেজে পা দিয়েছি। গায়ে স্কুলের গন্ধ লেগে আছে। আমি ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে ক্লাস করা শুরু করেছি। এখনও ফুল দমে ক্লাস শুরু হয়নি। এর মধ্যে আমাদের বাড়ির সামনে রহিম কাকার বড় মেয়ে মিতা আপার বিয়ে আহা কি আনন্দ ! আজ মিতা আপার গায়ে হলুদ ছেলের পক্ষ থেকে গায়ে হলুদের সব জিনিস আসবে আমরা অপেক্ষা করছি।
সবাই হলুদ শাড়ি পরলাম ,আমার লম্বা চুলের বেনীতে হলুদ গাঁদা ফুলের মালা দিয়ে জড়িয়ে নিলাম। জীবনের প্রথম শাড়ি পড়ার আনন্দ অন্য রকম লাগছে। এর মধ্যে মিতা আপার গায়ে হলুদের সব জিনিস নিয়ে একগাদা ছেলে এসে হাজির। একদিকে এক ঝাঁক তরুণী অন্য দিকে এক ঝাঁক তরুণ সব মিলিয়ে হৈ হৈ কান্ড। তখন ছিলো না এতো মোবাইলের ঘনঘটা , ডিজিটাল ক্যামেরা। কিন্তু ছিলো অনাবিল আনন্দ,স্মৃতিতে ধরে রাখার মতন।
ছেলেগুলো মিতা আপার গায়ে হলুদের সব জিনিস বের করে দেখিয়ে দিচ্ছে। সব ঠিকঠাক আছে কি না। আমরা খুব মজা করে দেখছি। আমরা সবাই গোল হয়ে বসে আছি আর ওনারা মজা নিচ্ছে, এক ফাঁকে তমাল নামের একটা ছেলে আমার চুলের বেনী ধরে টান দিয়েছে; আর আমার চুলে জড়ানো মালাটা খুলে গেল। ওমনি তমাল মালাটা নিয়ে দৌড়। বাড়ি শুদ্ধ মানুষের সে কি হাসাহাসি। তমাল দিব্যি মামলাটা গলায় দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছেলে গুলো আজ যাবে না, এখানেই থাকবে আগামীকাল বরের সাথে যাবে।
আমরা সকলে কাগজ কেটে গেট সাজানো, বরের স্টেজ সাজানো , কীভাবে গেট ধরবো এসব নিয়ে ব্যস্ত। আর তমালরা উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখছে আমরা কি করছি। হঠাৎ দেখি তমালের হাতে একটা সিগারেট আমি দৌড়ে গিয়ে বললাম আপনি খুব খারাপ। ছি ছি সিগারেট খাচ্ছেন, ওমনি তমাল সিগারেটটা ফেলে দিয়ে জুতা দিয়ে দুমরে মুচড়ে শেষ করে দিলো। দেখেছেন আমি কতো ভালো , আমি লজ্জায় এক দৌড়।
বিয়ে বাড়ির সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ মিতা আপার বিদায় ,আমাদের সকলের মন খারাপ। হঠাৎ দেখি তমালের গলায় ঝুলানো একটা ক্যামেরা নিয়ে আমার দিকে আসছে। আমার খুব লজ্জা লাগছে, তখন তো রিল ক্যামেরা গুনে গুনে ছবি তোলা। ডিলিট করার কোন অপশন নেই । তমাল আমার দিকে ক্যামেরা রেডি করেছে আর আমি দুহাতে মুখ ঢেকে ফেললাম। জানি না সেদিন কি ছবি তুলছিলো? ছবি তোলার পর খুব ঝগড়া হয়েছিল।
আর কোনদিন তমালের সাথে আমার দেখা হয় নাই। দীর্ঘ পচিঁশ বছর অনেক সময় ,আমাদের দুজনেরই পৃথক দূটো জীবন। যে যার মতো করে সংসার করছি , ভুলে গেছি অতীতের সেই সুখস্মৃতিকে। কিন্তু ছবি খানা রয়ে গেছে তমালের কাছে।
মনে মনে কতোবার ভেবেছি তমাল একবার আসুক অন্ততঃ ছবি খানা দিয়ে যাক। ও তো বলেছিলো এখন ভর্তি পরীক্ষা দেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে,এইটুকু এর বেশি কিছু সে যুগে বলা সম্ভব ছিলো না। কিন্তু তমাল কোনদিন আসে নাই, হয়তো ভুলে গিয়েছে। সময়ের প্রয়োজনে আমিও ভুলে গিয়েছি।
কিন্তু পঁচিশ বছর পর হঠাৎ দেখি মিতা আপার ফেসবুক আইডি সঙ্গে সঙ্গে রিকোয়েস্ট পাঠালাম এক্সাসেপ্ট করলো। তারপর দেখলাম তমাল ,মিতা আপার ফেসবুক ফ্রেন্ড। হ্যাঁ সত্যিই তমাল, মনে পড়ে গেল অতীতের সেই সুখস্মৃতি।
তমালের আইডি লক করা নাই ঠিক আমার মতন। ওর আইডিতে ঢুকলাম। দেখলাম ওর বউ বাচ্চা আরও অনেকের ছবি। দেখতে দেখতে একদম শেষে গিয়ে দেখি একটা ষোল/ সতের বছরের মেয়ে দুই হাতে মুখ ঢাকা তার একখানা ছবি। আমি না বিশ্বাস করতে পারছিনা আমি ঠিক দেখছি তো ? হ্যাঁ একদম ঠিক দেখছি।এই তো আমার সেই কালো বেল্টের ঘড়ি আর লালের উপর গোল্ডেন কালারের কাজ করা জামা।
ছবি টা পোস্ট করার সময় সে লিখেছে। সে ছিলো আমার প্রেম,এবং প্রথম ভালোবাসা। আমি তাকে দেখেছি ঠিক যৌবনের শুরুতে ,তাকে স্পর্শ করিনি। কারন তার কাছাকাছি পৌছাবার যোগ্যতা আমার ছিলো না। তাই তো কখনও যায়নি, যখন আমি যোগ্যতা সম্পন্ন,স্বাবলম্বী একজন মানুষ হয়ে উঠলাম। ঠিক তখনই মিতা ভাবি জানিয়ে দিলো ,আজ মোহনার বিয়ে।
সবাই আমাকে ক্ষমা করবেন ছবি খানা ফেরত দেয়নি এই স্মৃতি টুকু রেখে দিয়েছি পরম যত্নে, গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায়। আজ এই ডিজিটাল যুগে অনেক প্রেম ভালোবাসার জন্ম হয় ,কিন্তু সত্যিই কারের প্রেম কয়জনের মধ্যে বিদ্যমান।
আমি ছবিখানা দেখলাম এবং লেখাটা পড়লাম। মনের অজান্তে চোখের কোণে জল জমে গেল। তারপর কমেন্টস পড়তে শুরু করলাম। অনেকেই অনেক কিছু লিখেছে। আর তমালের স্ত্রী লিখেছে ষাট দশকের এই নায়িকা কে ? তাও ভালো তমালের স্ত্রীর হিসেব অনুযায়ী হয় আমি বৃদ্ধ ,না হয় মৃত।
বুঝতে পারলাম সত্যিকারের ভালোবাসা হারিয়ে যায় না। বেঁচে থাকে পরম যত্নে, গভীর শ্রদ্ধায়। কোন বিকৃত মানসিকতায় নয় ,কোন অসম্মান নয় ,ভালবাসা থাক হৃদয়ে, বিশ্বাসে, প্রার্থনায় ….
ইসরাত জাহান – কবি ও লেখক