Take a fresh look at your lifestyle.

বউ পর্ব- দুই

1,107

 

জৈষ্ঠ্যমাস। নদীতে ভাটা। শমসের মোল্লা তার তিনজন মাল্লা নিয়ে মাঝিমাল্লাদের পীর বদর বদর ধ্বনি দিয়ে নৌকার নোঙর তুলে উজানের পথে যাত্রা শুরু করলো। এখন যেমন ডিজেল ইঞ্জিনের সাথে দস্তার প্রপেলার লাগিয়ে দ্রুতগতিতে নৌকা চলছে, তখন এটা কল্পনাও করা যেতো না। স্রোতের প্রতিকূলে চলার একমাত্র উপায় ছিলো গুনটানা আর বাতাস অনুকূল থাকলে পাল খাটানো। গুন টানার জন্য হাত-খানেক লম্বা মসৃণ করে চাঁছা একটা দণ্ড ব্যবহার করা হতো। এই গুন শিল্পের সাথে বংশপরম্পরায় কতো লোক জড়িত ছিলো, তারা কালের পরিক্রমায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মধ্য জৈষ্ঠ্যের এ সময়টাতে প্রচণ্ড গরম আর বাতাসের প্রবাহ না থাকায় গুনটানাই শমসের মোল্লার ভাগ্য হয়ে দাঁড়ালো। তার তিনজন মাল্লা আনছের,মুনতাজ আর রহিম বক্স মাস্তুলে গুন বেঁধে ডাঙায় নেমে পড়লো যার যার গুন কাঁধে। সেকালে মাল্লারা মাঝিকে পিতার মতো শ্রদ্ধা করতো। মানুষের শ্রদ্ধাবোধ দিনকেদিন হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে যেনো! সকাল থেকে পৌনেদুপুর অবধি গুন টানার পর বাকি দুজনকে ডাঙায় রেখে আনছের রান্নার কাজে নৌকায় উঠে এলো। আনছের ছিল বাবুর্চি। দুপুরবেলা নলখোলার ঘাটে যাত্রা বিরতি দিল, ডাঙায় পাঁচ কাঁটাওয়ালা গেরাফি ফেলে। সরিাষার তেল দিয়ে গোলআলু ভর্তা, অপূর্ব মধ্যাহ্নভোজ! ওলন্দাজ বংশোদ্ভূত গোলআলু তখনো এদেশে শেকড় গাড়েনি। খাওয়া শেষে ভালোমতো এক ছিলিম তামাক সাজলো আনছের আলী। অগ্নিসংযোগ করে হুকোটা শমসের মোল্লার দিকে এগিয়ে ধরলো –কাকা দরো।হুঁকোর গুড়গুড় শব্দের তালে খুশবুদার ধোঁয়া নিমেষেই সব ক্লান্তি দূর করে দিল যেনো।
তামাকের যে কতো বাহারি মশল্লা ছিল তা আর বলার না।বড় একটা চারকোণা বারকোশের একপাশে কুঁচিকুঁচি করে কাটা তামাক পাতা চিটাগুড় দিয়ে মাখানো থাকতো, আর ডানপাশে থাকতো সারিবদ্ধভাবে সাজানো হরেকরকম সুগন্ধির শিশি। আর ঐ সুগন্ধির টানে বাচ্চারা প্রায়ই মন্ত্রমুগ্ধের মতো তামাকের দোকান ঘিরে বসে থাকতো।
ঘণ্টাখানেক বিশ্রামের পর মাল্লারা আবার নেমে পড়লো, কারণ আঁধার ঘনালে আর গুনটানা যাবে না। তাদের সেদিনের গন্তব্য বলাচলে নির্ধারিতই ছিল। শমসের মোল্লা তার বড় মাল্লা (সিনিয়ার) রহিম বক্সকে আগেই বলে রেখেছিল — যত কষ্টই হোক, মাছখালির কোল পর্যন্ত পৌঁছাতেই হবে। তাদেরই মতো অসংখ্য চালানি নৌকা মাছখালির কোলে রাতেরবেলা নোঙর করে থাকতো। ঘোরসন্ধ্যায় তারা মাছখালির দক্ষিণ তীরে নোঙর করলো। কারণ ততক্ষণে উত্তর পাশের পাড়জুড়ে নৌকা আর নৌকায় ভরে গেছে। এ সময়টাতে সাধারণত ঈশানকোণ থেকে ঝড় ওঠে, যেজন্য উত্তর পাড়টা আগেভাগে দখল হয়ে যায়। উত্তর পাড়ের নৌকাগুলো ঝড়ের কবল থেকে অনেকাংশেই নিরাপদ থাকে।
রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে শমসের মোল্লা কাজলির মা’র নিজহাতে সেলাই করা জায়নামাজ হাতে নৌকার ছইয়ের ওপর উঠলো এশার নামাজ আদায় করতে। তারকাখচিত সুন্দর আকাশ দেখে শমসের মোল্লা প্রাণভরে আল্লাহতায়ালার শুকরিয়া আদায় করলো। নামাজান্তে আল্লাহর দরবারে দুইহাত তুলে দুআ করলো — ইয়া আল্লাহ, তুমি রহমানুর রহিম, তোমার দয়া বেশুমার। পরিবারপরিজন রাইখা আমরা দূরদেশে যাত্রা করছি। তুমি সবাইরে রক্ষা কইরো মালিক!…. …. নামাজ শেষে সামান্য সময় কি যেনো ভাবলো জায়নামাজে বসে,তারপর জায়নামাজ গুটিয়ে হাতে নিয়ে ডানদিকে একনজর তাকালো। তাকানোর সাথেসাথে মনের ভেতর কেমন যেনো খটকা লাগলো তার। মনে হলো উত্তরের আকাশটা কেমন যেনো কালো রং ধারণ করেছে। শমসের মোল্লা আরও পনেরো মিনিটের মতো সময় ঈশানকোণের দিকে তাকিয়ে আকাশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলো।ততক্ষণে আকাশের অবস্থা যা পরিবর্তন হবার কথা হয়ে গেছে। নিমেষেই শমসের মোল্লার মনের পর্দায় ভেসে উঠলো চার চারটি পরিবার, রক্ত পানি করা কষ্টার্জিত পয়সায় তৈরি করা তার সাধের নৌকা ; মহাজনের এত টাকার চালান। সব। শমসের মোল্লার পুরো দেহ থরথর করে কেঁপে উঠলো। অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করলো — ইয়া রহমানুর রহিম, রক্ষা কর! গায়ে যতটা জোর আছে ততটা জোর দিয়ে হাঁক দিয়ে উঠলো যাতে সমস্ত মাঝিমাল্লার কানে পৌঁছায় — কইরে, তোরা সব তাড়াতাড়ি বাইরে আয়! ঝড়ি উইঠ্যা আইলো!

আবু সাইফা- কবি ও সাহিত্যিক।

Leave A Reply

Your email address will not be published.