Take a fresh look at your lifestyle.

বিহঙ্গ মোর

1,270

 

অনেক রাতে টলতে টলতে বাসায় ফিরে তারেক। ড্রাইভার বেলাল তাকে ধরে ধরে কামরায় পৌঁছে দেয়। এটা আজকাল তারেকের প্রতিদিনের রুটিন। কামরায় ঢুকে ধরাচূড়া সহ ধপাস করে বিছানায় শুয়ে যায় তারেক। শোয়া মাত্র ঘুম। বিকট শব্দে নাক ডাকতে থাকে। আরশি ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে তারেকের পা থেকে জুতাজোড়া খুলে সু র‍্যাকে রেখে দেয়। বাথরুম থেকে ছোট তোয়ালে ভিজিয়ে পরম যত্নে পা দুটো মুছে বিছানায় তুলে দেয়। আস্তে আস্তে জামার বোতামে হাত দেয়। জামা কাপড় মাত্র পাল্টে শেষ করেছে অমনি আড়মোড়া ভেঙে ওঠে দাঁড়ায় তারেক। টলমল পায়ে বাথরুমের দিকে এগিয়ে যায়। আরশি ধরতে চাইলে হাত দিয়ে সজোরে সরিয়ে দেয়। বাথরুমে ঢুকে বমি করতে থাকে। আরশি চুপচাপ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। বাথরুম থেকে বের হতে তোয়ালেটা এগিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করে,
– খাবে কিছু?
হাতটা তুলে ইশারায় বারণ করে। আরশি বারণ না শুনে ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়।আজ তারেকের প্রিয় মাগুর মাছের ঝোল রান্না হয়েছে। হটপটে রাখা ভাত থেকে একটা প্লেটে অল্প ভাত, দুই পিস মাছ, আলু আর ঝোল নিয়ে কামরায় আসে। আরশি জানে বমি করে তারেকের ক্ষিদা লেগেছে। আরশি ভাত নিয়ে যেতে বিনা প্রতিবাদে আরশির হাতে খেয়ে নেয় তারেক। খাওয়া শেষ করে পানি টা এগিয়ে দিতে দিতে আরশি বলে,
– যা পারো না তা কেন করতে যাও বলো? প্রতিদিন এত এত ড্রিংক করে বাসায় এসে বমি কর। শুধু শুধু শরীরটাকে কষ্ট দেয়ার কোন মানে হয় বলো?
কথা শেষ না হতে ঝনঝন শব্দে চমকে ওঠে আরশি। প্লেটটা ঘরের কোনায় ছুঁড়ে ফেলেছে তারেক।
– কি হলো? এমন করছো কেন?
– তো? কি করবো আমি? আর কি করতে বলো আমাকে?
প্লেট ছুঁড়ে ফেলার শব্দে মঞ্জুলা বেগম বিছানা ছেড়ে ওঠে আসেন
– কি হয়েছে তারেক? মাঝরাতে কি শুরু করলি তোরা? তোদের জ্বালায় রাতে একটু ঘুমাতে ও পারবো না?
– কি হয়েছে তোমার আদরের বউকে জিজ্ঞেস কর। মাঝরাতে তিনি আমার কাছে কৈফিয়ত চাইতে বসেছেন আমি কেন ড্রিংক করি। আমি সুখে ড্রিংক করি বুঝলে? সুখে….. সুখে
মঞ্জুলা বেগম তেতে ওঠে তারেকের কথা শুনে,
– আরশি এসব কথা মাঝরাতে জিজ্ঞেস করতে হবে তোমাকে? এটা যে একটা ভদ্রলোকের বাড়ি এটা ও মনে করে দিতে হবে নাকি? ঠিকই তো ড্রিংক করা ছাড়া আছে কি ওর? ওর জীবনে তো কোন সুখ শান্তি দিতে পারো নি।।আজ বারটা বছর বিয়ে হয়েছে,ওর সব বন্ধুদের ছেলেমেয়ে হাইস্কুলে পড়ছে। আমার ছেলে তো কপালে করে সেসব আনেনি। ও যদি একটু ক্লাবে গিয়ে বন্ধুবান্ধব নিয়ে একটু সময় কাটায় তাতে ও তোমার বাধ সাধতে হবে?
– মা আমি ক্লাবে যেতে বারণ করিনি
– চুপ কর তুমি..। মুখে মুখে শুধু তর্ক। ক্লাবে যেতে বারণ করনি কিন্তু ড্রিংক করতে বারণ করছো। জলে নেমে গোসল করবে কিন্তু চুল ভিজবেনা তাকি হয় নাকি? কেলেংকারি না বাড়ালে হচ্ছে না তোমার। মাঝরাতে আর কথা না বাড়িয়ে সব পরিষ্কার করে শুয়ে যাও। আমার তো ঘুমের রফাদফা করলে।বাকি রাত আর ঘুম আসবে কিনা কে জানে…। যাই আমি।
মঞ্জুলা বেগম ফিরে যেতে প্লেট টা কুড়িয়ে নিয়ে মঞ্জুলা কিচেনে চলে যায়। কলের নিচে প্লেট রেখে কলটা ছেড়ে দিয়ে কাঁদতে থাকে সে। অনেকক্ষন কান্নাকাটি করে মুখে পানি দিয়ে কামরায় ফিরে এসে দেখে তারেক ঘুমিয়ে গেছে। লাইট নিভিয়ে বিছানার কিনার ঘেঁষে শুয়ে যায় সে। রাত এখন প্রায় আড়াইটা। বাকি রাত আর ঘুম আসবে না আরশির। তারেকের সাথে প্রথম দেখার কথা মনে পড়ে। কবির আন্টির বাসায় আরশিরা ভাড়া থাকতো। আরশি তখন পাশ করে একটা কলেজে জয়েন করেছে। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। ব্যাংকার বাবা, ছোট আরো তিনভাইবোন আর মাকে নিয়ে পরিবার। আরশির শ্যামলা চাপা গায়ের রং অনেকাংশে চাপা পড়ে যেতো তার দীঘল কালো চুল আর শান্ত আয়তলোচনায়। তার এ কমনীয় শান্ত রূপের জন্যই মনে হয় মিসেস কবির ও তাকে সর্বদা চোখে হারাতেন। যখন তখন ডাক পরতো তার বাসায়। আরো একটা কারণ ও অবশ্য ছিল। ছোট বেলা থেকে অসাধারণ গাইতে পারতো সে। যাকে বলে কিন্নরকণ্ঠী সে। সেদিন কলেজ ছুটি ছিল। বেশ বেলা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছিল সে।আন্টির কাজের মেয়েটা এসে বলে,
– আফা আফনেরে খালাম্মা বুলায়…
কেন, কি কারণ জানতে না চেয়ে কোনরকমে হাতমুখ ধূয়ে বিছানা থেকে ওড়না টা গলায় পেঁচিয়ে রওনা দেয় সে। ভেতরে ঢুকে থতমত খেয়ে যায় আরশি। ড্রইংরুমে বসে আছেন এক কম বয়সের ভদ্রলোক,সাথে বয়স্কা একজন ভদ্রমহিলা।সম্ভবত মা, ছেলে। মিসেস কবির আরশিকে দেখে বলেন,
– চোখ মুখ তো ফুলে আছে।ঘুম থেকে তুলে এনেছে? দেখ দেখি কি কান্ড! ডেকে আনতে বলেছি বলে কি ঘুম থেকে তুলে দিতে বলেছি নাকি? নাস্তা তো হয়নি মনে হয়, এখানে খেয়ে নাও। আমার ও মাথা নষ্ট।বুঝা উচিত ছিলো আজকে তোমার ছুটির দিন
– না আন্টি সমস্যা নেই। আসলে কালকে অনেক রাত জেগে একটা বই পড়ছিলাম।তাই সকালে ওঠতে দেরী হয়ে গেছে। এমনিতে ও ওঠে যেতাম। এরমধ্যে নূরবানু গিয়ে বললো আপনি ডেকেছেন।
পাশ থেকে মঞ্জুলা বেগম উত্তর দেয়,
– তোমার আন্টি ডাকেনি। তোমার এত গল্প শুনেছি তোমার আন্টির কাছে তাই আমি ডেকে আনতে বলেছি। তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছা করছিলো।
আরশি ঘুম থেকে জেগে খোলা চুলে চলে এসেছে। পাশে বসে আরশির চুলে হাত বুলাতে বুলাতে মিসেস কবিরের দিকে তাকিয়ে বলে,
– শাহানা এত মিষ্টি একটা মেয়ে পাশে নিয়ে বসে আছ তুমি আর আমাকে এতদিন পর জানালে? খুব খারাপ করেছ তুমি
– ভাবী ও কিন্তু খুব সুন্দর গান করে। আরশি শুনিয়ে দাও একটা গান।
আরশি একবার মিসেস কবিরের ভাবী আরেকবার পাশে বসা ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে ইতঃস্তত করতে থাকে।
– এখন?
– হ্যা এখন ই তো….ও তোমার সাথে তারেকের সাথে পরিচয় হয়নি তাই না? ও আমার ভাইয়ের ছেলে।ঢাকা য়ুনিভার্সিটি থেকে পাশ করে শিপিং ব্যাবসা করছে।
তারেকের দিকে তাকিয়ে বলে,
– তারেক ওর নাম আরশি। আমাদের ওপরের ফ্ল্যাটে থাকে। চট্টগ্রাম য়ুনিভার্সিটি থেকে ইংলিশে পাশ করে বিসিএস করে চট্টগ্রাম কলেজে জয়েন করেছে।
আরশি সালাম দেয় তারেককে। তারেক শুধু মাথা নাড়ে। দুচোখ জুড়ে তার মুগ্ধতা।মুখে বলে,
– এবার তাইলে একটা গান হোক….
শাহানা ও বলে,
– হ্যা শুরু কর…
স্বভাবে অতিমাত্রায় নরম শরম মেয়ে আরশি এড়াতে পারে না,কিছু না ভেবেই গায় সে,
“চোক্ষে আমার তৃষ্ণা, ওগো তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে ”
গান শেষ হতে তারেক যেন অবচেতন মনে বলে ওঠে,
– অপূর্ব…. আর একটা প্লিজ
সেদিন ফার্স্ট ফ্লাইটে ঢাকা থেকে এসে পৌঁছায় মঞ্জুলা আর তারেক।
সাড়ে এগারটা পর্যন্ত আটকে রাখে ওরা আরশিকে। চলে আসার সময় দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেয় তারেক।বের হওয়ার সময় তারেক আরশির গান অনুকরণ করে গায়,
– ” চোক্ষে আমার তৃষ্ণা, ওগো তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে”।
তারপরে বলে,
– এ তৃষ্ণা কি আদৌ মিটবে?
শ্যামলা মুখে রক্তকণিকার ছুটাছুটি দেখতে দেখতে তারেক বলে,
– বিকেলে যাচ্ছি আপনার বাসায়। জবাবটা না হয় তখন জেনে নিব
একছুটে লিফ্ট এ ঢুকে যায় আরশি। ওই লোকের চোখের সামনে ওই এক ধাপ সিঁড়ি ডিঙ্গোতে ইচ্ছে করেনি। বাসায় ঢুকে এক দৌড়ে কামরায় ঢুকতে যেতে মায়ের সামনে পড়ে যায়।
– এত অস্থির হয়ে কোথায় যাচ্ছিস?
– ঘুমাবো মা আমায় ডেকো না
– নাস্তা করবি না?
– ও বাসায় খেয়ে এসেছি।
সেদিন বিকেলে মিসেস কবির তার ভাবী আর ভাইপো নিয়ে বেড়াতে চলে আসেন।
হঠাৎ করে বাসায় মেহমান নিয়ে আসাতে মা একটু হচকচ অবস্থায় পড়ে যান। আরশি গিয়ে মাকে সাহায্য করে। চা নাস্তা নিয়ে আসা যাওয়ার মধ্যে একজোড়া মুগ্ধ দৃষ্টির সাথে বারবার দৃষ্টি মিলিয়ে যাচ্ছিলো। সে দৃষ্টিতে যেন অপার তৃষ্ণা। কাছে আসার, পাশে বসার। অনেকক্ষন গল্প গুজব করার পরে ফিরে গেলেন। বের হওয়ার সময় ওর হাতে একটা চিরকুট গুজে দিয়ে তারেক বলে,
– ফোন নাম্বার আছে।ফোন করলে খুব খুশি হব।অপেক্ষায় থাকবো
সারারাত খুব দোলাচলে কাটে আরশির চিরকুটটা একবার হাতে নেয়, দেখে আবার ভাজ করে রেখে দেয়। আবার হাতে নেয়, আবার….।সারারাত এভাবে পার করে করে শেষরাতে ঘুমিয়ে যায় আরশি।একঘুমে দুপুরের আগে আগে ওঠে সে।ঘুম থেকে জেগে দেখে সব ভাই বোনরা ওর দিকে তাকিয়ে মুখ টিপেটিপে হাসছে।
– কি হয়েছে তোদের? তোরা হাসছিস কেন?
ভাইবোনের কাছে কোনো সাড়া না পেয়ে এবার মাকেই জিজ্ঞেস করে,
– মা ওরা হাসছে কেন?
– কিছু না…. তুই ভালো করে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নে।
এবার অন্যদের দিকে তাকিয়ে
– তোরা এখান থেকে সব যা।ওকে আর জ্বালাসনে।
– কেনো মা কোথাও যাবে?
আরশি জিজ্ঞেস করে।
পাশ কেটে চলে যাওয়ার সময় ঊর্ষি বলে,
– আপা দুলাভাইকে কিন্তু আমার খুব ভালো লেগেছে।
– মা ঊর্ষি এসব কি বলছে
– আজকে শাহানা ভাবী এসেছে সকালে। ওরা তারেক ছেলেটার জন্য তোকে চায়।
– তোমরা কি হ্যা বলেছ মা?
– কিছু বলিনি,তুই কি বলিস?
– মা সম্পর্ক সমান সমান হওয়া ভালো। ওরা অনেক বড়লোক।
পরদিন কলেজ যাওয়ার জন্য বের হয়ে গেইটের কাছে যেতে তারেকের সাথে দেখা হয়ে যায়। সৌজন্য বিনিময় করে রিক্সায় ওঠে বসতে ওর পাশে হুট করে তারেক ও ওঠে বসে। থতমত খেয়ে আরশি আপত্তি জানায়,
– আপনি কোথায় যাচ্ছেন। আমি তো কলেজ যাচ্ছি
– আমি ও
রিক্সাওয়ালার পিঠে হাত রেখে বলে,
– চাচা আপনি চালান
আরশি কি বলবে বুঝতে না পেরে অন্যদিকে চেপে বসে। তারেক বলে,
– আরশি তোমার সাথে কিছু কথা আছে তাই এভাবে তোমার সাথে বসেছি।
– বলুন
– তোমাকে জিজ্ঞেস করবো না ফোন কেন করনি….। জবাব আমি পেয়ে গেছি। আরশি আমাকে বিয়ে করতে না চাওয়ার কারণ জানতে পেরেছি। শুনলাম আমার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এর কারণ। বড়লোক হওয়া যে এতবড় ক্রাইম হতে পারে আমার ধারণা ছিল না। এক মাস লাগবে সব বিক্রিবাট্টা করে বিলি করে ফিরে আসতে। ততদিন অন্তত তুমি অপেক্ষা করো।
আরশিকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে ওকে রীতিমত হতভম্ব করে দিয়ে রিক্সা থেকে নেমে যায় তারেক।
রাতে একসাথে খেতে বসে আরশির বাবা নিজাম উদ্দীন আহমেদ বলেন,
– বুঝলে জাহানারা বিয়েটা মনে হয় না দিয়ে পারলাম না।
আরশি মুখ নিচু করে খেতে থাকে। জাহানারা জিজ্ঞেস করে,
– সবদিক ভেবে দেখেছ?
– হ্যা…..। আজ ছেলেটা আবার আমাকে গেইটের কাছে এসে ধরলো,
– আংকেল শুধুমাত্র আমার টাকাপয়সাই যদি বিয়েতে একমাত্র বাধা হয় তাইলে সব বিলিয়ে দিই? ভাবছি এতটা আগ্রহে না করলে আমার মেয়েটার ওপর অভিশাপ পড়বে।
দুইমাস পরে তারেকের সাথে বিয়ে হয়ে যায় আরশির। ঢাকায় তারেকের কামরায় দিয়ে সবাই যখন সরে যায় তারেক কামরার এক কোণে রাখা গ্রামাফোন রেকর্ড টা মৃদুসুরে ছেড়ে দেয়….। সেই গান, ” চোক্ষে আমার তৃষ্ণা…”। মুগ্ধ হয়ে গান শুনছি। আজকাল গ্রামাফোন খুব একটা দেখা যায় না। পাশে এসে বসে হাত দুটি ধরে বলে,
– যেদিন দেখি সেদিন থেকে একবুক তৃষ্ণা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
শুরুতে সবকিছু এত ভালো যাচ্ছিলো সব,কেমন যেন স্বপ্নের মত মনে হচ্ছিলো সব। দুজনে মিলে বসলে কত কত গান, কবিতা পাঠ, এছাড়া বিভিন্ন দেশ বিদেশের বই নিয়ে আলোচনা। তারেকের পড়াশোনার গভীরতা অনেক।আরশির তো আছেই। দুজন দুজনের সঙ্গ বেশ ভালোভাবে উপভোগ করতো। ধাক্কাটা খায় আরো বছর তিনেক পরে। যখন বাচ্চা নেয়ার কথা ভাবে। শুরুতে এখানকার এই ডাঃ, সেই ডাঃ। পরে দেশ ছেড়ে বিদেশে। কোথাও কারো কোনো সমস্যা নেই। ডাঃ শুধু বলে,
– সময় দেন হবে।
ইংল্যান্ড গিয়ে চেষ্টা করে টেস্টটিউব বেবির। শুরুতে কত খুশি দুইজনে।বাচ্চা নিয়ে কত কল্পনা, জল্পনা, কি নাম হবে,কত কি? তিনমাস থেকে চলে গেল বাচ্চাটা। আরো ভেঙে পড়ে দুজনে। তারেকের টা চোখে পড়ার মত। তখন থেকে শাশুড়ি মঞ্জুলা বেগমের মুখ ম্লান হতে থাকে। তারেক ও হতে থাকে আস্তে আস্তে বহির্মুখী। সকাল বেলা অফিসে চলে যায়, সেখান থেকে ক্লাব হয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে মাঝরাত। আরশি সারাদিনে একটা কথা বলার মানুষ পায় না। শাশুড়ির সাথে কথা বলতে গেলে দুই তিনটা কথা বলার পরে মুখ ঝামটা খেতে হয়। কি করবে আরশি? এভাবে শেয়াল কুকুরের মত লাথি খেয়ে পরে থাকবে? নাকি চলে যাবে? কোথায় যাবে সে? বাবার বাড়ি এখন হয়েছে ভাইদের সংসার। মা বাবা ওদের ওপর। নতুন করে আরশির দায়িত্ব কি ওরা খুশি মনে নেবে?বিয়ের পরে চাকরিটা ছাড়তে হয়েছে।
সকাল থেকে সারা বাসা গুমোট হয়ে আছে। তারেক অফিসে চলে গেছে। বাসার রান্না আজকাল মঞ্জুলা বেগম করেন। তারেকের মুখে আজকাল তার রান্না রোচে না। সারা সকাল টুকটাক গোছগাছ করে দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে শাশুড়ি শুতে যেতে একটা চিঠি লিখে তারেককে আরশি,
তারেক,
চললাম, না বুঝে অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। পারলে ক্ষমা করো। জীবনটা গুছিয়ে নিও। এখনো খুব বেশি দেরী হয়নি।

আরশি

স্যুটকেসটা হাতে নিয়ে দরজা খুলে লিফট্ এর বাটন টা টিপ দিয়ে একপাশে দাঁড়ায় আরশি।দরজা খুলতে চমকে যায় সে। তারেক…..।
– রেডি?চল
হাত ধরে তারেক আরশির।লিফট্ নিচে নামতে থাকে। হাত ধরেই বের হয়।টেনে গাড়িতে নিয়ে যায়,
– কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
– তোমাকে তুলে দিয়ে আসি? চিটাগাং যাবে তো?
চুপ করে যায় আরশি।দুইচোখে পানি টলমল করে তার। রুদ্ধস্বরে বলে,
– আমি যেতে পারবো
– তাতো পারবে….। তবে কি জানো এই হাতটা ধরে একদিন আমার বাসায় গৃহপ্রবেশ হয়েছিলো তোমার। বিদায়টা একা কি করে দিই বলো?
আরশি আর কিছ বলে না।একটা মার্কেটের সামনে গাড়ি থামাতে বলে বেলালকে।আরশিকে বলে,
– তুমি একটু বসো গাড়িতে….। দুইমিনিটে ফিরছি।
আধঘন্টার মধ্যে হাতে কয়েকটা প্যাকেট নিয়ে ফিরে আসে। গাড়ি এয়ারপোর্টে নামিয়ে দেয় তাদের। ফ্লাইটের এনাউন্সমেন্ট শুনে চমকে তারেকের দিকে তাকায়।হাতের মধ্যে আরশির একটা হাত নিয়ে চাপ দিয়ে আস্বস্ত করে তাকে তারেক।
এক ঘন্টার মধ্যে হোটেল গ্র্যান্ড সুলতানে পৌঁছে যায় তারা। কামরায় ঢুকে সব রেখে আরশি জিজ্ঞেস করে,
– এটা কি হলো?
– তুমি কি ভেবেছিলে? সত্যি সত্যি তোমাকে চিটাগাং পৌঁছে দিতে যাচ্ছি? পাগল…. কি করে এটা ভাবতে পারলে তুমি?
আরশিকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আয়নার কাছে এসে ওর চুলে মুখ ডুবিয়ে বলে,
– একবার আয়নার ভেতরে চোখ রেখে দেখতো আরশি আমাদের দুজনের মাঝখানে ভালোবাসা কমে গেছে কিনা?
ছাড়াতে চেষ্টা করে আরশি, পারেনা।তারেক আরো জোরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে তাকে,
– আমি ঠিক বুঝেছি কাল রাতে মায়ের ওসব কথা শোনার পরে তুমি এমন একটা কান্ড করবে তাইতো ছুটতে ছুটতে চলে আসলাম।
আরশির দুচোখে আর বাঁধ মানে না। হেচকি তুলে কাঁদতে থাকে সে।তারেক আরশির মুখটা বুকে চেপে ধরে রাখে। অনেকক্ষন কাঁদার পরে শান্ত হয় আরশি।তারেক আরশির মুখটা তুলে,দুই হাতে ওর চোখ দুটো মুছে দিয়ে চোখের পাতায় আলতো চুমু খায়। বুকের মধ্যে মুখটা চেপে ধরে বলতে থাকে,
– আরশি দুইটা মানুষের সুখী হওয়ার জন্য বাচ্চা ছাড়া ও অনেক কিছু আছে। আমরা সেসবকে আঁকড়ে ধরবো। মানলাম আমার অনেক ভুল আছে। নিজেকে সামলাতে পারিনি। তুমি শক্ত হাতে হাল ধরবে না? এত সহজে ছেড়ে দিবে?

“যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে,
সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া,
যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে,
যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া,
মহা আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে,
দিক-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা-
তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।”

এবারে আরশি তারেকের সাথে গলা মেলায়,

ওরে ভয় নাই, নাই স্নেহ মোহ বন্ধন,
ওরে আশা নাই, নাই বসে বৃথা ক্রন্দন।
ওরে গৃহ নাই, নাই ফুলশেজ রচনা,
আছে শুধু পাখা, আছে মহানভ অঙ্গন।
ঊষা দিশাহারা নিবিড় তিমির আঁকা,
ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর
এখনি অন্ধ বন্ধ করো না পাখা।

শামীমা নাসরিন- কবি ও সাহিত্যিক।

Leave A Reply

Your email address will not be published.