Take a fresh look at your lifestyle.

মনের মুকুরে – ২

460

প্রাণীকূলের মধ্যে মানুষই শ্রেষ্ট।মানুষের প্রাণ আছে, আবার মনও আছে।শুধু প্রাণটুকু নিয়ে বেঁচে থাকার মধ্যে মানুষের শ্রেষ্টত্ব প্রমানিত হয় না।প্রাণের সাথে মনটাকেও বাঁচিয়ে রাখতে হয়।খাওয়া পেলে প্রাণ বাঁচে, কিন্তু মন বাঁচে না, মনের জন্য খাদ্য রস নয়, প্রযোজন হয় ভিন্ন রস, অনুভবে উপলদ্ধিতে সেই রুপ রস বাইরের সুন্দর প্রকৃতি জগত থেকে তিল তিল করে আহরণ করে নিতে হয়।সুস্থ সবল সুন্দর ভাবে মনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রকৃতির সব সুন্দর অসুন্দরের সাথে সুতো বিহীন গাঁথুনি দিয়ে তৈরি করে নিতে হয় এক অদৃশ্য সখ্যতা।স্বার্থহীন ভালবাসা ছড়িয়ে দিতে হয় শতরুপা প্রকৃতির বুকে।আপন করে নিতে হয় এর প্রতিটি ধূলিকণা, সকাল সন্ধ্যায় জেগে উঠা জল বিন্দু।সেই মনকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনে কম বেশি সব মানুষই হয়তো বারবার ছুটে যায় সেই প্রকৃতির কাছে।কেউ ছুটে যায় পাহাড়ে, কেউ হেঁটে বেড়ায় নদীর কুলে, আবার কেউ কেউ উড়ে যায় সমুদ্র উপকূলে।এই অর্থ ব্যয়, এই ছুটাছুটি শুধু মাত্র মানষিক তৃপ্তির জন্যে, আত্মার প্রশান্তির জন্যে।
রবীন্দ্রনাথের সেই অমর অমীয় বানী- ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দু’পা ফেলিয়া’।হয়তো দেখি নাই, দেখেছিও হয়তো কেউ কেউ সেই-‘একটি ধানের শিষের উপর একটি শিশির বিন্দু’।কিন্তু সেই দেখা কতটুকু, কিভাবে দেখেছি, সেটা হয়তো অনেকে কখনো ভেবে দেখি নাই।চোখ দিয়ে কি সেই শিশির বিন্দুর সৌর্ন্দয্য সত্যিই অর্থে দেখা যায়।চোখের দেখা সত্যিকারের দেখা নয়। দেখতে হয় মনের চোখ দিয়ে, মনের সব দরোজা জানালা খুলে দিয়ে, সেই সুন্দরকে ভালোবেসে একান্ত আপন করে নিয়ে দেখতে হয়।সেই দেখা হয় সত্যিকারের দেখা।হৃদয়ের দেখা সুন্দরই আমৃত্যু হৃদয়ের ঘরে উজ্জ্বল হয়ে বেঁচে থাকে।
বয়সগত কারণে আমি আমার শিশু-শৈশবকাল কে হারিয়েছি, কিন্তু হারিয়ে যেতে দিই নি আমার শিশু শৈশবের সেই প্রাণচঞ্জল হৃদয়ের সবুজ সত্বাটাকে।যেখানে সুন্দর আর অসুন্দর হাত ধরাধরি করে আজও বেঁচে আছে।চোখ খুলে জেগে আছে আমার হৃদয়ের ভেতরে, আনন্দ বেদনার সুর লহরীতে।
পড়ন্ত বয়সের কোন এক বিকেল বেলায়, আমি এসে দাঁড়িয়েছি আমার গ্রামের বাড়ির দক্ষিনে খালের পাড়ে।আমার গ্রামের নাম গোলাবাড়িয়া।ধান চাল খেসারির গোলা নয়, লবনের গোলা।শ্রুত কাহিনীতে আছে, সন্দীপ যখন মগের মুল্লুক হিসেবে খ্যাত ছিল, সেই সময়ে আমার আদি পুরুষ প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে, সন্দীপ থেকে পালিয়ে এসে সমুদ্রের এপাড়ে আশ্রয় নিয়েছিল, পরবর্তিতে বসক বাড়ি গড়ে তুলেছিল।জীবিকার প্রয়োজনে শুরু করেছিল লবনের চাষ।সেই লবন রাখার জন্য প্রয়োজন ছিল মাটির তৈরি পাত্র, যার নাম গোলা।গ্রামে গোলা পুকুর বলে একটা পুকুর আজও আছে। শুরুতে কিন্তু সেটা পুকুর ছিল না, লবন মাঠি গরম জলে সেদ্ধ করার জন্য পানির প্রয়োজন হতো। সেই পানি সংগ্রহে রাখার জন্যে করা হয়েছিল খাদ বা কুয়া।কুয়ার পাশে ছিল লবনের খলা, কুয়ার পাড়ে রাখা হতো লবন ভর্তি এসব মাটির গোলা।সেই গোলা থেকে পরবর্তিকালে গ্রামের নাম হয়ে গেছে গোলাবাড়িয়া।গোলাবাড়িয়া গ্রামটি আকৃতিতে খুব ছোট্ট একটি গ্রাম।আকৃতি নয়, প্রকৃতি ছিল এই গ্রামের সবচেয়ে বড়ো বিশেষত্ব।খালে বিলে আবৃত, সবুজে আচ্ছাদিত সুন্দর একটি গ্রাম।
ছোটবেলায় আমার বাড়ির সামনে কাচারির খলায় এসে দাঁড়ালে চোখের সামনে দাঁড়িয়ে যেতো পূর্বাকাশ আড়াল করা সুউচ্চ চন্দ্রনাথ পাহাড়, আর বাড়ির পেছনে গেলে শুনতে পেতাম বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ের গর্জন।ডান দিকে চোখ ঘুরালে চোখের দৃষ্টি গিলে খেত বিশাল এক রাক্ষুসে বিল, যার নাম কয়ালের বিল হিসেবে সর্বজন পরিচিত ও খ্যাত ছিল।আর বামে হাতের মুঠোতে আবদ্ধ ছিল, আমার শিশু শৈশব জীবনের অর্ধেক গিলে খাওয়া, আনন্দ সুখের অন্যতম খেলার সাথী, সমুদ্রের লোনাজলে সদা ভাসমান এক খাল, সমুদ্র আর পাহাড়িয়া ঝর্ণার লীলাখেলায় যার জন্ম হয়েছিল বলে শুনেছি, নাম ছিল গুলিয়াখালি খাল।
খাল বলতে আমার শৈশবে দেখা জ্ঞান অভিধানে যা ছিল, বর্তমানে অবশ্য সেই অভিধানে ময়লা পড়ে সেটা ভরাট হয়ে গেছে।তাই খাল নেই,খালের পাড়ও নেই।খালে জলও নেই জোয়ার ভাঁটাও নেই।খালের তলানীতে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে দম বন্ধ করে পড়ে আছে জল নামের ঘোলাটে হলুদ রংয়ের কিছু তরল আর্বজনা। জলশুন্য কাদা মাটির বুকে লেপটে আছে কিছু হলুদ পাতা আর শুস্ক খড়িকাঠ।শুকনো কাদায় হা হয়ে আছে কোন এক বয়স্ক মানুষের গোটা কয়েক পায়ের ছাপ।জল নয়, পাতা নয়, কাদা গর্তে ভেসে থাকা পায়ের ছাপের উপর আমার চোখের দৃষ্টি স্থির হয়ে গেঁথে থাকে।
আমি পেছনে ফিরে কিসব হাতড়াতে শুরু করি।কোন এক কালে, আজ থেকে অর্ধশত বছর আগে এই খালও তার কৈশোবের দুরন্তপনা নিয়ে বেঁচে ছিল উজান ভাঁটার স্রোতধারায়।সেই দুরন্ত জল তরঙ্গে জল ছলছল শব্দে পাড়ের দুইপাশে উপচে পড়তো, সারা বছরই সকাল বিকেল দু’বেলায় সমুদ্রের জোয়ার জলে ভেসে যেত খালপাড়, দু’পাশের ঝোপঝাড়,খাল পাড়ের বাড়ি ঘরের উঠান আঙ্গিনা মাঠ।আর আমরা গ্রামের দুরন্ত শিশু কিশোরেরা সেই জলের মাছ হয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতাম।কখনো ডুব সাঁতারে, কখনো ভাসমান সাঁতারে আমাদের শরীরকে করেছি বারবার স্নাত-প্লাবিত, আনন্দ উল্লাসে মনকে করেছি চাঙ্গা।ভাঁটার টানে পানি যখন খালের মাঝ বরাবর নেমে আসতো, তখন সেই এক ভিন্ন আনন্দ।কাদা জলে মিশিয়ে খালের পাড়কে স্লিপার বানিয়ে চিড়চিড় চিড়চিড় করে করে গড়িয়ে যেতাম জলের স্রোতে, নাম ছিল যার চিচ্ছিরি খেলা।
সেই কাদা জল মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে, সাঁতার কেটে আমরা নিজেদেরকে করেছি শারীরিক ভাবে শক্ত সবল, মনকে করেছি সাহসী, দৃঢ়।গ্রামীন জীবনে আমরা বড়দের কাছ থেকে লক্ষ হাজার বার শুনেছি, ‘গাঁইয়্যা পোলা মাডিত পইল্লে লোহা’।

 

হাসনাত হারুন – কবি, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ।

Leave A Reply

Your email address will not be published.