আমার স্বামী কানচোরা স্বভাবের। ঝগড়াঝাটি ছাড়া কিভাবে তাকে সোজা করেছি সেই গল্পই আজ আমি আপনাদের সাথে করব।
আমার শ্বশুড়বাড়ি গ্রামে, গ্রামেই থাকি। দাদা শ্বশুরের আমলের পুরনো একটা ছাদের ঘর আছে। রান্না ঘর হিসেবে ব্যবহার করতাম। বর্ষাকালে পানি পড়ে, তাই বাতিল হয়ে গেছে। লাকড়ির চুলায় রান্না করতাম, ছাদে কালি লেগে আছে। পুরনো কিছু ভাংড়ি জিনিস থাকে।
আমার স্বামী ভিষণ কানচোরা স্বভাবের মানুষ। সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় কোনো কিছু ফুরিয়ে গেলে, তিন চার বার বলার পর নিয়ে আসে। অসহ্য লাগে, কিন্তু ঝগড়া করি না। ঝগড়াঝাটি অশান্তি, আমার ভালো লাগে না।
চা পাতা ফুরিয়ে গেছে, বলে দিলাম আনতে কিন্তু আনেনি। মোটে দুবার বলেছি।
বৃষ্টির দিন সন্ধ্যাবেলায় স্বামী বলল,
চকলেট (মাঝে মাঝে এই নামে ডাকে) ঝাল পেঁয়াজ দিয়ে মুড়ি ভেজে আনো আর চা। উনি আবার রং চা খায়।
আমি হাসি মুখে চা বানাতে গেলাম। চা বানাব কি? চাপাতি তো নেই।
দুটো বাটি নিয়ে পুরনো ঘরে গেলাম, ছাদে কালি লেগে আছে, বৃষ্টির পানি চুইয়ে মেঝেতে পড়ছে। রংটা ঠিক চায়ের মতো, আমি সেই পানি বাটিতে ধরলাম। মুড়ি ভেজে, সেই পানি গরম করে চিনি মিশিয়ে, স্বামীর সামনে হাসি মুখে ধরলাম।
এক কাপ দেখে বলল, তুমি খাবে না?
না আজ আমার চা খেতে ইচ্ছা করছে না।
ঠিক আছে,তাহলে আমি একাই খাই।
খুশি মনে গরম ধুমায়িত চা এক চুমুক খেয়েই ওয়াক থু থু করতে করতে বলল, এ তুমি কি বানিয়েছ!এটা চা না অন্য কিছু?
আমি সরল মুখে বললাম, উপরওয়ালা তোমার জন্য আসমান থেকে স্পেশাল চা পাঠিয়েছেন, তারপরও তোমার ভালো লাগল না!
তারমানে?
মানে হলো, চা পাতা নেই। পুরনো ঘরের ছাদ চুইয়ে পড়া বৃষ্টির পানিই চা।
অবাক হয়ে বলল, ঐ পানি তুমি আমাকে খাওয়ালে! মুখ দেখে মনে হয়, ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না। পেটে পেটে এত দুষ্টু বুদ্ধি। ছাতা দাও চা পাতা এনে দিচ্ছি।
এর কিছুদিন পর, চাল ফুরিয়ে গেছে। বলে দিলাম চাল শেষ, না কিনলে আগামী কাল দুপুরে ভাত হবে না।
ঠিক আছে আমি সকালে এনে দেবো।
সকালে চা নাস্তা খেয়ে বাড়ি থেকে চলে গেল। চাল নিয়ে আর আসে না।
আমি ইচ্ছা করলে পাশের বাড়ির থেকে চাল আনতে পারতাম অথবা আমার জমানো টাকা দিয়ে চাল কিনতে পারতাম। কিন্তু আমি সেটা করলাম না।
দুপুরের জন্য মাংস, মাছ, ডাল, সবজি রান্না করলাম।
দুপুরে ভাত খেতে এসে টেবিলে বসে বলল, বাঃ আজকে তো ভালো ভালো রান্না করেছ , দাও ভাত দাও।
সরল মুখে বললাম, ভাত নেই।
তার মানে?
ভাত রান্না করিনি।
অবাক হয়ে বলল,কেন রান্না করনি?
চাল নেই।
ওহ্,আমি ত ভুলেই গেছি। তুমি আমাকে একটা ফোন করবা না।
ফোন করলে, ফোনের টাকা এবং কথা বললে আমার শক্তি অপচয় হতো।
স্বামী হতভম্ব গলায় বলল, কি সব আবোলতাবোল কথা বলো?
বা রে তুমি না সেদিন বললে, অপচয় করবে না, মিত্যব্যায়ি হও, হিসেব করে চলতে হয়।
আমার কথা শুনে রাগে, চেয়ারে লাথি দিয়ে বলল, বদ মেয়েছেলে এ নিয়ে সংসার করা যায়?গজগজ করতে করতে চাল আনতে গেল।
ফিরে আসার পর, আমি লক্ষি মেয়ের মতো ভাত রান্না করে খেতে দিলাম।
এরপর থেকে আমার স্বামীর কানচোরা ভাব কেটে গেছে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস আনার কথা বলতে হয় না। জিনিস থাকতেই চলে আসে। একদম সোজা হয়ে গেছে।
শুধু রাগ ঝগড়া করে না, বিটলামি করেও মানুষকে সোজা করা যায়।
ইসরাত জাহান নিতা- গল্পকার, উপন্যাসিক ও সাহিত্যিক।