Take a fresh look at your lifestyle.

বিশ্ব নবীর জীবন কথা – এক

661

 

যিনি সারা জাহানের রব, পালন কর্তা, অসীম দয়ার সাগর, মহাজ্ঞানী সর্বশক্তিমান। যিনি আমাদের শ্রেষ্ট জীব হিসাবে তৈরী করেছেন, সকল প্রশংসা সেই মহান আল্লাহর। মানব জাতীর শ্রেষ্ট নেতা হিসাবে যাকে প্রতিষ্টিত করেছেন,সে সর্বশ্রেষ্ট মানব রাসুল মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রতি অশেষ ছালাম ও দরুদ। যিনি সারা জগতের জন্য রহমত স্বরূপ এসেছেন এই দুনিয়ায়। তিনি হলেন হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ)।

রসুল (সাঃ) এর জন্মের পূর্বে আরব্য প্রেক্ষাপট।

রাসুল (সাঃ) জন্মের আগের অন্ধকার যুগকে আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগ বলা হয়। সারা আরব দেশের মানুষের মধ্যে তখন গোমরাহি বিরাজ করত।
সে যুগে সভ্যতা ঈমানদারী একা নিভৃতে কেঁদে বেড়াত। চারিদিকে শিরক, অন্যায়, অবিচার, হত্যা, যুদ্ধ বিগ্রহ ইত্যাদির সমারোহ ছিল। ছিল শিরকের বিশ্বজনীন ব্যধি। ছিল ভ্রান্ত জাতিভেদের ফেতনা। বানানো ধর্মীয় ও সামাজিক রীতি-নীতিই সেখানে চলত। ছিল হাজারো মুর্তি -প্রতিমা। চলত
মুর্তি পূজা, ঘুড়ি পূজা, সূর্য পূজা, অগ্নি পূজা। তাদের মধ্যে ভাগ্যের দোহাই ছিল এবং তা কিছু মানুষের জন্য খারাপ পরিনতি নিয়ে আসত।

তৎকালীন আরবে পতিতাবৃত্তিও বাদ পড়েনি। দেব মন্দিরে হতো ভাগ্য গননা। ছিল তালাকের পর তালাক দেওয়া স্বামী স্ত্রীকে বার বার গ্রহন করার নিয়ম। চলতো এতিমদের উপর অন্যায় অত্যাচার। তাদের প্রাপ্য ধন সম্পত্তি থেকে তাকে বঞ্চিত করা হতো। সে যুগে কখনো কন্যা সন্তানদের জীবিত কবর দেওয়া হতো। কখনো নারী শিশুদের উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত করা হতো। একে অপরকে হত্যা করত এবং তার প্রতিশোধ চলতো একের পর এক হত্যা দিয়ে।

সেই সময়ে আরব দেশে মুষ্টিমেয় লোক বাস করতেন যারা এক আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তারা হানিফ নামে পরিচিত ছিলেন।

নিরীহ আরব বাসী সব সময় চিন্তিত থাকতো কখন কোন লুন্ঠনকারী দল এসে হঠাত আক্রমন করে বসে। মোট কথা আরবের অবস্থা এমন ছিল যে , গোটা দেশে এমন কোন জনপদ ছিল না যারা শান্তিতে থাকত।

এই অন্ধকারের পর্দা সরিয়ে দিয়ে এক মহা আলোকের আবির্ভাবের বড় প্রয়োজন হয়েছিল। তাইতো মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার সেরা বিচক্ষনতা দিয়ে এক মহান উদ্দেশ্যে এই পৃথিবীর বুকে তার সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মাখলুকাত শ্রেষ্ঠ মানুষ আমাদের নবী (সাঃ) কে প্রেরণ করেন। আবির্ভাব হয় এক মহা আলোক সত্তার, যার পবিত্র আলোতে সারা পৃথিবী মাতোয়ারা।

রাসূল (সাঃ) এর জন্মঃ

পবিত্র মক্কা নগরীর কুরাইশ বংশের মান মর্যাদা আভিজাত্য আরব দেশের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ট ছিল। আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সাঃ) ইবরাহিম (আঃ) এর বংশধর ছিলেন। তার পিতা আব্দুল্লাহ ছিলেন মক্কার কুরাইশ নেতা আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র। তার মাতা ছিলেন আমিনা।

১২ রবিউল আউয়াল সোমবার সুভে সাদিকের এক পবিত্র মুহুর্তে রাসুল (সাঃ) এর জন্ম হয়। শিতের বিদায়ী লগ্নে নব বসন্তের আগমনের ছোয়ায় তৃনশাখা প্রশাখায় সবুজ নব পল্লব প্রায় সমাগত। প্রকৃতি যেন কীসের মায়ামন্ত্রে মোহাচ্ছন্ন। পূর্ব আকাশে এক পবিত্র নামের জানান দিয়ে সূর্য উদয়ের আয়োজন চলছে। আলো আধারে যেন কীসের কানাকানি শুনা যায়। মা আমিনার মনে স্বপ্নেরা দোলা দিয়ে যায়। আকাশের চাঁদ বুঝি কোলে এলো তার তাই খুশিতে আত্মহারা। আল্লাহর প্রিয় বন্ধু রাসুল (সাঃ) নেমেছেন মাটির ধরায়। কুল মাখলুক তাই বুঝি এত খুশি। সপ্তাকাশে ফেরেস্তারা ছুটাছুটি করছে তার আসার আয়োজনে। পবিত্র আরব নগরীতে প্রভাতী আলোক শিখা শুভাগমনী বার্তা নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল চারিদিকে।
দাদা মুত্তালিব যখন খবর পেলেন খুশির আবেগে তিনি প্রসূতি ঘরেই চলে গেলেন। নিজের ছেলের মুখটি স্মরন করে শিশু পৌত্রকে উঠিয়ে নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরলেন। নাম রাখলেন মুহাম্মদ (সাঃ)।

রাসুল (সঃ) এর পিতা আব্দুল্লাহ আব্দুল মুত্তালিবের সর্বকনিষ্ঠ সর্বাপেক্ষা সুদর্শন এবং প্রিয় পাত্র ছিলেন। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। পুত্র আব্দুল্লাহর অকাল মৃত্যু হওয়ায় তার সদ্য ভুমিষ্ট সন্তান রাসূল (সাঃ) এর প্রতি আব্দুল মুত্তালিবের হৃদয়ের টান অনেক বেশি। তিনি নাতির জন্মে খুশি হয়ে দেশের প্রথা অনুযায়ী মহা সমারোহে উৎসব পালন করলেন। এবং গরিবদের মধ্যে উট বিতরন করলেন।

দুধমাতা হালিমার কাছে রাসুল (সাঃ) এর গমনঃ

আরব দেশের সম্ভ্রান্ত বংশমর্যাদা সম্পন্ন পারিবারের নবাগত শিশুদের গ্রাম্য বেদুইন ধাত্রীদের কাছে পাঠানো ছিল একটা রীতি বা রেওয়াজ। ধাত্রীমাতা অন্যের শিশু সন্তানদের নিজের বুকে আগলে রেখে লালন-পালন করতেন। এর বিনিময়ে তারা যথোপযুক্ত পারিশ্রমিক পেতেন।

রাসুল (সাঃ) এর দুধমাতা নির্ধারণের সময় এলো। গ্রাম অঞ্চল থেকে ধাত্রীরা এলেন। ধনী পরিবারের সব শিশুদের দুধমাতা নির্বাচন হলো। দুধমাতারা শিশুদের নিয়ে নিজ গৃহে রওয়ানা হলেন। কিন্তু আমাদের নবী (সাঃ) ছিলেন এতিম শিশু। আমিনা ছিলেন এক দরিদ্র বিধবা রমনী। তাই তার সন্তান প্রতিপালন করে ভালো পারিশ্রমিক পাওয়া যাবে না মনে করে কোন ধাত্রীই তাকে গ্রহন করলো না।

হালিমা নামে একজন ধাত্রী ছিলেন। তিনি গরিবের স্ত্রী। কিন্তু তার স্বভাব চরিত্র ছিল অতি উত্তম। তিনি তায়েফ থেকে একটি দুর্বল উটে চড়ে এসেছিলেন। তাই তিনি সবার শেষে উপস্থিত হয়েছিলেন। ততক্ষনে অন্য সবাই চলে গেছেন। শুধু আমিনার শিশুটি মায়ের কোলেই রয়ে গেছেন। হালিমা শিশু মুহাম্মদ (সাঃ) এর দায়িত্ব গ্রহন করলেন। তাকে নিয়ে তায়েফে রওনা হলেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, শিশু সন্তানটিকে কোলে নিয়ে উটের উপরে উঠে বসতেই উটের গায়ের শক্তি বেড়ে গেল এবং খুব দ্রুত চলতে লাগলো। যারা হালিমার আগে ছিল তাদের পিছনে ফেলে সবার আগে মা হালিমা নিজ গৃহে পৌছলেন। সকলে ব্যপারটি প্রত্যক্ষ করে খুব অবাক হলো।

রাসুল (সাঃ) কে হালিমার বাড়িতে নিয়ে যাবার পর পরই তার গৃহে সব দিক দিয়ে বরকত হলো। অনেক উন্নতি হলো তাদের। আর সুখ শান্তিতে ভরে উঠলো তার গৃহ প্রাঙ্গণ এবং তার জীবন।

মা হালিমা ছোট্ট রাসুল (সাঃ) কে খুব ভালো বাসতেন। তিনি আদর যত্নে সব সময় তাকে ভরিয়ে রাখতেন। নিজের সন্তানদের চেয়ে কোন অংশে তাকে কম ভালোবাসেননি।

শিশু নবী (সাঃ) একটু একটু করে বড় হচ্ছেন। হাঁটি হাঁটি পা পা করে হাঁটতে শিখছেন। আধো আধো বুলে কথা বলার চেষ্টা করছেন। আর তার সৌন্দর্যের আলোক রশ্মি যেন ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে।

তিনি একটু বড় হলেন যখন, দুধ ভাইরা ছাগল চড়াতে যাওয়ার সময় তাকে সাথে নিয়ে যেত।
দুই বছর পূর্ন হলেই মা হালিমার মন আনচান করে উঠল। তার অতি আদরের নয়নের মনি মুহাম্মদ (সাঃ) কে যে ফিরিয়ে দিতে হবে। যাকে বুকে ধরে তিনি শান্তির ছোঁয়া পান, যার লালন পালনে এত ভালোলাগা এত আনন্দ। তাকে ছেরে তিনি কেমন করে থাকবেন ? কিন্তু কিছু করার নেই। তাই দুই বছর পুর্ন হলেই শর্তানুসারে হালিমা হজরত আমিনার কাছে মুহাম্মদ (সাঃ) কে নিয়ে যান।
কিন্তু তার মন যে বড়ই অস্থির হয়ে উঠেছে। কেমন করে সে ছেলেকে রেখে একা বাড়িতে ফিরে যাবে।
তিনি প্রথম দর্শনে লক্ষ করেছিলেন, তার ফুটফুটে চাঁদ মুখ, খিল খিল হাসি, সুরমা রাঙা চোখের চাহোনি, গায়ে গোলাপের মিষ্ট সুগন্ধ।
যে শিশুটি কখনো বিছানায় এবং গায়ে পেশাব পায়খানা করেনি। সে শুধু তার একটি স্তনের দুধ খেয়েছে। অন্য স্তনের দুধ তার দুধ ভাইয়ের জন্য রেখেছে। এত বিচক্ষণ ছিল সেই ছোট্ট শিশুটির আচরণ। তার জন্য বুকের গভীরে বেদনারা কেঁদে মরছে বার বার।
এদিকে আমিনা নিজের সন্তানকে কাছে পেয়ে যেন হাতে স্বর্গ পেলেন। তবে মক্কায় তখন রোগের প্রাদুর্ভাব ছিল। সেই সুযোগে বুদ্ধি করে হালিমা হজরত আমিনাকে বললেন, মক্কায় মহামারি ও অন্যান্য রোগের প্রকুপ। এই অবস্থায় ছেলেকে আমার সাথে নিয়ে গেলেই ভাল হয়। রোগ বালাই কমলে আবার নিয়ে আসবো। হজরত আমিনা রাজি হলেন। হালিমা তার প্রিয় শিশুটিকে নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলেন। আবার আলোকিত হলো সারা বাড়ি।

হালিমা রাসুল (সাঃ) এর খুব খেয়াল রাখতেন। এক দিন তার বড় মেয়ে শায়মা তার কুরাইশী ভাইকে নিয়ে গ্রামের কাছাকাছি একটি মেলা দেখতে গিয়েছিল। হালিমা শিশুটিকে আশে পাশে না দেখে বিচলিত হয়ে পড়েন। কিছুক্ষন পরে শায়মা ফিরে এলে তিনি ছেলের কুশল জানতে চান। শায়মা বলে, কুরাইশ ভাইয়ের কোন কষ্ট হয়নি। কোন রোদ তাকে ছোঁতেও পারেনি। সারাক্ষণ আকাশের এক টুকরো মেঘ ওর উপর ছায়া করছিল। সে সময় কোন সাধারন মানুষ চিন্তাই করতে পারেনি যে ভবিষ্যতে এই শিশু একদিন বিশ্বসেরা মানুষ রূপে আত্মপ্রকাশ করবেন।

ছোট ভাইটিকে ছাড়া দুধ ভাই বোনের মেষ চরাতে ভালো লাগতো না। একদিন তিনি ভাই বোনদের সাথে মাঠে খেলা করছিলেন। হঠাত দু’ জন সাদা পোশাকধারী লোক সেখানে উপস্থিত হলেন। তারা শিশু মুহাম্মদ (সাঃ) কে ডেকে নিলেন। একটু আড়ালে গিয়ে তাদের মধ্যে একজন মুহাম্মদ (সাঃ) কে শুইয়ে রাখলেন। অপরজন ছুরি দিয়ে কেটে ভিতরের সব কিছু বের করে জমজমের পানি দিয়ে ধুয়ে কালিমা মুক্ত করে দিলেন। এবং বিশ্ব নবীর দায়িত্ব গ্রহন করার জন্য এক অপূর্ব শক্তি দান করে গেলেন। সমগ্র পৃথিবীকে মহান আল্লাহর প্রেমের সঙ্গে আবদ্ধ করার এক নিগূঢ় তত্ত্ব রেখে গেলেন।

এই খবর মা হালিমা শুনে ভিষন চিন্তায় পরে যান। খুব সকালে স্বামীকে সাথে নিয়ে হালিমা মক্কার দিকে রওয়ানা দিলেন এবং মা আমিনার হাতে শিশুকে তুলে দি্লেন।

হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) -এর বাল্যকালঃ

রাসুল (সাঃ)-এর জন্মের পূর্বেই মা আমিনা অনেক শুভ লক্ষন প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তার গর্ভে যে এসেছে সে সাধারন কেও নয়। তাই ছেলেটাকে নিয়ে তার অনেক আশা, স্বপ্ন আর আনন্দ নিয়ে দুঃখ ভুলে ভবিষ্যতের দিন গুনছেন।

শিশু মুহাম্মদ (সাঃ) একটু একটু করে বড় হচ্ছেন। তিনি দৃষ্টি মেলে দেখেন উপরে নীল আকাশ,নির্জন ধু ধু প্রান্তর, খেজুর গাছের বাগান, বেদুইন আরবীদের তাবু। কোথাও জীর্ন কুটির কোথাও বড় বড় অট্টালিকা। তিনি লক্ষ করতেন প্রতিদিনের সুর্য উঠা, দিনের শুরু, সুর্যের অস্তাচল, দিনের শেষ, রাতের শুরু। রাতের অন্ধকারে কর্মক্লান্ত শ্রান্ত মানুষ ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে। রাতের তারাভরা আকাশ, রুপালি চাঁদ তার মনে প্রশ্ন জাগায়। তিনি মনে মনে ভাবেন, প্রকৃতির এত নিয়ম-কানুন, এত কার্যকলাপ কার ইশারায় ঘটছে ? নিশ্চই তিনি অনেক বড় কেউ, মহা শক্তির অধিকারী, মহাজ্ঞানী। সেই মহান রাব্বুল আলামিনকে তিনি যেন হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারেন।

সে যুগে ঘরে ঘরে মুর্তিপূজা হতো। কেউ করত বৃক্ষ পূজা, কেউ সূর্য পূজা, কেউ অগ্নি পূজা, আবার কেউ নদী সাগর বা বিভিন্ন জীব জন্তুকেও পূজা করত। ছোট থেকেই কোনদিন রাসুল (সাঃ) এর মনে মুহুর্তের জন্যও এসব ব্যপার স্থান করতে পারেনি। বরং এসব দেখে তার ছোট মনে বিরক্তির সৃষ্টি হয়েছে। তিনি এসবের বিরোধিতা করেছেন।

তিনি মাঝে মাঝে শুনতে পেতেন পর্বতের দিক থেকে কে যেন তাকে ডেকে বলছে-হে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) তোমার উপর আমাদের ছালাম।
এই অদৃশ্য বানী শুনে তিনি চারিদিকে তাকাতেন, কিন্তু কিছুই দেখতে পেতেম না।
তিনি প্রকৃতির চলনের ধারাবাহিকতা দেখে মনে মনে কি যেন ভাবতেন। কখনো কখনো চিন্তায় মগ্ন হয়ে থাকতেন।

ছয় বছর বয়সে আমিনা পুত্রকে নিয়ে মদিনায় গমন করলেন। সেখানে কিছুদিন অবস্থান করে মক্কায় ফিরে আসার পথে স্বামীর কবর জিয়ারত করতে যান। পুত্রকে তার পিতার কবর দেখান। কবর জিয়ারত শেষে মক্কায় ফেরার পথে তিনি রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যান। রসুল (সাঃ) এবার তার মাকেও হারালেন। দাদা মুত্তালিবের লালন-পালনে, ভরন-পোষণে কিছুদিন চলে যায়। যখন তার বয়স আট বছর তখন, দাদাও তাকে ছেরে চলে যান। দাদা আব্দুল মুত্তালিব চাচা আবু তালিবের কাছে রাসুল (সাঃ) কে দিয়ে যান। আবু তালিব তাকে আপন সন্তানের মতো ভালো বাসেন।

বাল্যকালে রাসুল (সাঃ) সাধারন বালকদের সাথে খেলাধুলা করতেন না। তিনি আমোদ-প্রমোদ পছন্দ করতেন না এবং মিথ্যা বলাকে ঘৃনা করতেন। মাঝে মাঝে তিনি তার চাচা আবু তালিবের মেষ চরাতেন।

আক্ষরিক জ্ঞান লাভের সুযোগ তার হলোনা। কিন্তু তিনি দুনিয়ার যে কোন মানুষের চেয়ে বেশি জ্ঞানী। তিনি শ্রেষ্ঠ ও উত্তম চরিত্রের ধারক হয়ে পৃথিবীতে প্রেরিত হয়েছেন। তার চরিত্রের আলাদা বৈশিষ্ট্য বাল্যকালেই পরিলক্ষিত হয়েছে। সততা, ন্যয়নিষ্ঠ, বিনয়, উদারতা, দয়া, দানশীলতা প্রভৃতি গুন তার মধ্যে বাল্যকালেই দেখা দিয়েছে। তবে একটি গুনের জন্য তিনি বেশি খ্যতি লাভ করেছেন। তা হলো আমানতদারী ও বিশ্বস্ততা। তিনি ছিলেন সকলের কাছেই পরম বিশ্বাসী। এই গুনের জন্য সকলের কাছেই তিনি “আল-আমিন” উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন।

চাচা আবু তালিব ব্যবসা করতেন। সেকালে আরব দেশে উটের পিঠে মাল বুঝাই করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হতো। পথে চোর ডাকাতের ভয়ে একসাথে অনেক বণিক মিলে দলবেঁধে পথ চলত। সে বণিক দলকে বলা হতো কাফেলা। একবার রাসুল (সাঃ) চাচার সাথে সিরিয়া যেতে চাইলেন। পথের কষ্টের কথা ভেবে আবু তালিব প্রথমে রাজি হলেন না। রাসুল (সাঃ) এর একান্ত ইচ্ছার কারণে শেষ পর্যন্ত তাকে সাথে নিয়ে যেতে হলো।

মক্কা থেকে সিরিয়া অনেক দূর। সেই দূর পথের মাঝে কুফা নামে একটি জনপদ আছে। সেখানে পথের পাশে বড় একটি আকরা জবল গাছ ছিল। সে গাছের কাছে বাহিরা নামক এক খ্রিস্টান দরবেশের আস্তানা ছিল। ইঞ্জিল আর তাওরাত কিতাবে তার অসাধারণ জ্ঞান ছিল। বাহিরা কিতাবে দেখেছিলেন, হেরা পর্বত থেকে বিশ্বনবী (সাঃ) এর আবির্ভাব হবে। আর তিনিই হবেন দুনিয়ার শেষ পয়গাম্বর। সে হেরা পর্বতটি মক্কায় অবস্থিত।
একদিন বাহিরা আস্তানা থেকে বের হয়ে দেখলেন, মক্কার দিক থেকে একটা কাফেলা আসছে। আর এক খন্ড মেঘ সে কাফেলাকে ছায়া দান করছে। কাফেলাটি এক সময় আকরা জবল গাছের নিচে এসে দাঁড়াল। মেঘও সে গাছের উপর ছায়া করে রইল। গাছটিও যেন ঝুকে পড়ে কাফেলাকে ছালাম জানাল। বাহিরা সন্দেহ করলেন, নিশ্চয় বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সাঃ) এই কাফেলায় আছেন। তিনি তাদের কাছে গিয়ে আলাপ পরিচয় করলেন। এবং তাদের খাবারের জন্য দাওয়াত দিলেন। বণিকগন খুশি হয়ে তার সাথে গেলেন। তবে বাহিরা লক্ষ করলেন, কাফেলার লোকজন তার সাথে চলে এসেছে অথচ মেঘ টুকরো গাছের উপরে ছায়া দান করছে। তিনি তখন কাফেলার প্রধান আবু তালিবকে জিজ্ঞেস করলেন, কাফেলার সব লোক কি এসেছেন ?
কাফেলার প্রধান আবু তালিব বললেন, আমরা একটা ছেলেকে মালপত্র পাহারা দিতে রেখে সকলেই এসেছি।
বাহিরা বললেন, এতো ভালো হলোনা। তাকে ডেকে আনুন।
একজন গিয়ে রাসুল (সাঃ) কে ডেকে আনলেন। তার সাথে সাথে মেঘ টুকরোও চলে এলো। বাহিরা তখন নিশ্চিত হলেন। নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করলেন। রাত্রে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে বাহিরা রাসুল (সাঃ) এর সাথে কথা বলেন। তার বিচিত্র সব স্বপ্নের কথাও তার কাছ থেকে শুনে নেন। এবং তার পিষ্ঠ দর্শন করে নবুয়াত চিহ্ন দেখে আরো নিশ্চিত হন। তিনি আবু তালিবকে গোপনে ডেকে সাবধান করে বলেন, আপনার ভাইপো সাধারন বালক নন। ইনি হলেন, শেষ নবী এবং বিশ্বনবী (সাঃ)। তাকে খুব সাবধানে রাখবেন। আপনি তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে যান। সিরিয়ার ইহুদিরা তাকে পেলে মেরে ফেলবে। এ কথা শুনে আবু তালিব রাসুল (সাঃ) কে নিয়ে দেশে ফিরে যান।

দিল আফরোজ রিমা – কবি ও সাহিত্যিক। 

Leave A Reply

Your email address will not be published.