বাহিরের পরিবেশের সব পুরুষরাই কি খারাপ, নাকি কিছু পুরুষ নামের কাপুরুষ আছে যাদের ভিতরটা খারাপ….?
আমার জীবনে একজন পুরুষ মানুষ ছিলেন বন্ধুর মত,যার একটা আঙ্গুল শক্ত করে ধরে খোলা আকাশের নিচে, নরম ঘাস, সবুজ মাঠে মিষ্টি বাতাসে ঘুরে বেড়িয়েছি। একেবারে ছোটবেলার কথা বলছি, যদিও সম্পর্কের মূল্য তখন কিছুটা হলেও বুঝি। সেই পুরুষ মানুষটার সাথে আমার আরও একটা সম্পর্ক ছিলো সেটা হলো বাবা আর মেয়ে।
আমার এখনো মনে আছে , আমি যখনই তার সাথে ছোটবেলা ঘুরতে বের হতাম, তখন অনেকেই আমাকে দেখে বলতেন, মেয়ে তো দেখতে শুনতে খুব ভালো মাশায়াল্লাহ। কেউ কেউ ভয় দেখিয়ে বলতেন, এই মেয়ে যখন বড় হবে তখন তো তাকে নিয়ে ভয় আছে! আর তিনিও কেনো জানি ভয় পেয়ে যেতেন। তিনি বুঝতে পারতেন না এটা আমাদের সমাজের মানুষের এক ধরনের ব্যাধি। মেয়ে যদি দেখতে ভালো হয় তাহলে তাকে নিয়ে ভয় আছে। বলবে, এই মেয়েকে তো নিয়ে যাবে রাখতে পারবে না। আবার মেয়ে যদি দেখতে খারাপ হয় বলবে,এই মেয়েকে নিয়ে তো ভয় আছে। কে নিবে এই মেয়েকে। সারা জীবন বাবা -মায়ের কাছে রাখতে হবে।
সমাজের মানুষের এই ভয় দেখানো কথা শুনে তিনি ভয় পেয়ে ভালোবাসাকে আড়াল করে আমাকে শুধু শাসন করলেন। আমাদের বন্ধুত্বটা আর রইলো না। তিনি শুধু একজন শাসনপ্রিয় বাবা হয়ে গেলেন। আমার হাত ছেড়ে দিলেন। বললেন, ‘ভিতরে থাকো বাহিরের পরিবেশ খারাপ’।
আমার আকাশ দেখা বন্ধ হয়ে গেলো। খোলা মাঠ, সবুজ ঘাস সব আমার কাছে অচেনা হয়ে গেলো। মনের মধ্যে একধরনের বিষন্নতা সৃষ্টি হলো। আর যাই হোক এরকম পরিস্থিতির জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। আস্তে আস্তে আমার মনের মধ্যে বন্ধুর মত বাবার প্রতি এক ধরনের অভিমান জমতে শুরু করলো সেই অভিমান কখন যে বারতে বারতে অভিযোগে পরিণত হলো টেরই পেলাম না।
তারপরও খুব গোপনে মনের এক কোনে একটা বিশ্বাস লুকিয়ে রেখেছিলাম,যে বাহিরের পরিবেশ খারাপ না।
আমার সেই বিশ্বাস সেদিন নড়েচড়ে গিয়েছিলো, যেদিন নুসরাতের গায়ে আগুন লাগানোর খবর পত্রিকায় পড়েছিলাম। আব্বুর প্রতি অভিমান আর অভিযোগ কিছুই রইলো না।
যেদিন স্বামী নামক অভিভাবকের হাতে তুলে দিয়েছিলেন সেদিন ভেবেছিলাম, এখন আর ভয় নেই। আমি মুক্ত। হয়তো এখন আর আমাকে ভয় পেতে হবে না। কিন্তু সেখানেও একই কথা, বাহিরের পরিবেশ খারাপ ভিতরে থাকো। আমার মধ্যে আবার সেই একই অভিযোগ। তবে এবারে যে অভিযোগ তা এত কয় বছরে একত্র করলে কয়েক বস্তা হবে। সেদিকে আর নাই গেলাম। আমার সেই বস্তা বস্তা অভিযোগ সব ধুলায় মিশে গেলো যেদিন সিলেটের এম.সি কলেজে স্বামীর সাথে ঘুরতে বেড়িয়ে স্ত্রী নির্মম ভাবে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন।
তারপরও আমি বুকের ভিতরে গভীর একটা যায়গায় খুব গোপনে এখনো বিশ্বাস করি পৃথিবীতে এখনো ভালো পুরুষ আছেন, থাকবেন। আমি বিশ্বাস করি আমার ভাই দু’জন ভালো পুরুষ, আমি বিশ্বাস করতে চাই আমার ছেলে সন্তান দু’টি বড় হয়ে ভালো পুরুষ হবে যারা নারীদেরকে মায়ের জাত মনে করে সন্মান দিবে। একজন বোন কে বিপদগ্রস্ত দেখলে তাকে বোনের মত সন্মান করে তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিবে। একজন বৃদ্ধা মাকে অসুস্থ দেখলে তার দিকে কাধ বাড়িয়ে দিবে। তবেই তো হবে সুপুরুষ।
আমি এও জানি, আমার মতো এরকম হাজারো নারী আছেন যারা বিশ্বাস করতে চায়, পৃথিবীতে সব পুরুষ খারাপ নয় সভ্য পুরুষ আছেন। যাদের কাছে নারী জাতি নিরাপদ।এখনো কিছু স্ত্রী তাদের স্বামী ঘরে ফেরার আগ পর্যন্ত নিশ্চিন্তে থাকে, তার স্বামী বাহিরের হাজারো ছলনার হাতছানি উপেক্ষা করে তাদের জন্য উপার্যন করে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরবে একটু শান্তির আশায়। এখনো কিছু ভালো পুরুষ আছেন যারা নারীদের কে ঘরে বন্দী করে না রেখে বলে, তোমাদের মনের বদ্ধ দুয়ার খুলে দাও। সেখান থেকে কিছু প্রশান্তির বাতাস আসুক। শীতল করে দিক মনের যত যন্ত্রণা ভরা অধ্যায় আছে সব। ভয় নেই। তোমরা নিরাপদ।কিছু সভ্য পুরুষ হয়ত এখনো আছেন, যারা অত্যন্ত দুর্বল মুহূর্তেও নিজেকে সংযত রাখতে পারেন।
এসব কিছুর পরেও কিছু প্রশ্ন থেকেই যায় ,যদি কন্যা শিশু থেকে শুরু করে, যুবতি মেয়ে, মা,বৃদ্ধাসহ সবাই পদে পদে লাঞ্ছিত হয়, ধর্ষিত হয়। যদি নারী জাতিকে আমরা নিরাপদে না রাখতে পারি, যদি বর্বরতার সীমা ছারিয়ে বিকৃত মনুষিকতার কাপুরুষের দ্বারা লালসার শিকার হতে হতে শেষ পর্যন্ত শবঘরে মৃত নারীর লাশও রেহাই না পায়! তাহলে কিভাবে দাবী করবো যে আমরা সভ্যজাতি??
এসব কিছুর পর মনের মধ্যে অজানা আশংকা দানা বাধে। আমার পুষে রাখা বিশ্বাস আর কাজ করে না। থমকে যাই আমি।
কাপুরুষদের কবল থেকে নিরাপদে থাকুক পৃথিবীর সকল নারী।
আর পৃথিবীর সকল সুপুরুষের প্রতি রইলো শ্রদ্ধা। আমি জানি, জীবনের শেষ বিদায়ের দিন চারজন পুরুষের কাঁধে চড়ে আমাকে যেতে হবে কবর স্থান পর্যন্ত। শত শত পুরুষ আমাকে সামনে রেখে পড়বেন জানাযার নামাজ। দু’জন পুরুষের সাহায্য ছাড়া আমি শুয়ে যেতে পারব না কবরের মধ্যে চীরনিদ্রায়।
মাহফুজা শিরিন- কবি, সাহিত্যিক ও মডারেটর চেতনায় সাহিত্য।