শৈশবের স্মৃতিময় মাহে রমজান
আমার শৈশব,কৈশোর বেড়ে উঠা সব সবুজ শ্যামল গ্রামে। আমাদের কাছে মাহে রমজান মাস ছিল অনেক বেশি বর্নিল উৎসবমুখর। প্রথমেই আমাদের বাড়ির একটু বর্ণনা দেই। আমার শৈশব কেটেছে একান্নবর্তী পরিবারে। আমার আব্বারা দশ ভাই তিন বোন। তার মধ্যে সাতজন গ্রামে ও তিন জন ঢাকায় থাকতো। আব্বা সবার বড়। তিন ফুপুর বিয়ে আমি ছোট থাকতেই হয়ে গিয়ে ছিল। ফুপুদের স্মৃতি আমার বেশি মনে নেই। তবে আমি মেঝ ফুপুর খুব ভক্ত ছিলাম। ফুপুর বিয়ের দিন নাকি কান্না করতে করতে আমার জ্বর এসে গিয়েছিল। ফুপাকে নাকি আমি দেখতেই পারতাম না ,ফুপুকে নিয়ে গেছিলো বলে। এক বছর আগে ফুপু আমাদের সবাইকে ছেড়ে অনেকদূরে চলে গিয়েছেন। আল্লাহ ফুপুকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন। দাদা-দাদি, চাচা- চাচি,ফুপু অনেকগুলো চাচাতো ভাই বোন, রাখাল, লজিং মাস্টার আর মসজিদের ইমাম সাহেব নিয়ে আমাদের বিশাল পরিবার ছিল । একদিনে দশ থেকে পনের কেজি চালের ভাত রান্না করা হতো। আমাদের বাড়িটা ছিল অনেক বড়। বড় একটা উঠোন তার চারপাশে দাদা-দাদির ঘর, চাচা- চাচির ও আমাদের চারচালা টিনের ঘর। দাদা-দাদির ঘরের পাশেই ছিল ঠেঁকি ঘর, রান্না ঘর আর দোচালা টিনের খাবার ঘর।দাদা-দাদির ঘরের পিছনে ছিল শান বাঁধানো পুকুর। পাশেই বাথরুম, গোসলখানা, চাঁপকল।চাঁপকলের পাশেই বড় একটা আমগাছ ছিল। গাছের গোড়ার চারদিকে পাকা করে বাঁধানো ছিল বসার জন্য। খাবার ঘরে আসবাবপত্র বলতে বড় একটা চৌকি, হাতল আলা চওড়া ও লম্বা একটা ব্রেন্চি আর একটা লম্বা টেবিল। আমরা ছোটরা সবাই চৌকিতে বসে খেতাম আর বড়োরা সবাই টেবিলে। ঘরের একপাশে নীচে সারি সারি ভাত,তরকারির পাতিল সাজানো থাকতো। মা চাচীরা সেখানে বসেই সবার খাবার পরিবেশন করতো। বড় একটা বাহিরবারি পেরুলে লম্বা একটা কাচারি ঘর তারপাশেই মসজিদ। মসজিদের পিছনেই আমাদের পারিবারিক কবরস্থান।
আমাদের চাল,সব্জি বেশিরভাগই নিজস্ব ক্ষেতে হতো।অল্পকিছু জিনিস বাজার থেকে কিনতে হতো। সেজন্য অনেক মানুষ হলেও কোন অসুবিধা হতো না।আমাদের ছোটবেলাটা হৈ হৈ করেই কেটেছে। সব কাজ মা চাচীরাই ভাগাভাগি করে করতো। তবে বাড়ির সর্বময় ক্ষমতা ছিল দাদা-দাদির হাতে। গোলা ভরা ধান,গোয়াল ভরা গরু,পুকুর ভরা মাছ,ক্ষেত ভরা সব্জি।সহজ ভাষায় বলতে গেলে সচ্ছল গৃহস্থবাড়ি। শুধু গৃহস্থবাড়ি বললে ভুল হবে। কারন আমার বাবা চাচারা প্রায় সবাই সরকারি চাকরিজীবি ছিল। ছোটবেলা থেকেই আমরা ধর্মীয় অনুশাসনে বড় হয়েছি। আমাদের ঘুম ভাঙতো আব্বা- মার কুরআন শরীফ পড়ার শব্দে।
রোজার মাস শুরু হওয়ার আগেই বাড়িতে কাজের ধুম পড়ে যেতো। ঘরদোর পরিস্কার করা,কাপড়চোপড় ধোয়া,ধান সিদ্ধ করা,ঠেঁকিতে ধান বানা, যাঁতায় ডাল পিষা,মুড়ি ভাজা আর মা পানি গরম করে আমাদের সব ভাই বোনকে সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে দিতো। আমাদের মসজিদে সবসময় খতম তারাবি হতো। সেজন্য দুজন কুরআনে হাফেজকে রাখা হতো। তাদের নির্বাচন করার দায়িত্ব ছিল দাদার উপর। তাদের থাকা খাওয়া সব আমাদের বাড়িতেই হতো।
রমজানের চাঁদ দেখাটাও ছিল অনেক মজার। সবাই মিলে মাঠে চলে যেতাম। চাঁদ দেখা গেলেই বাড়িতে একটা উৎসব শুরু হয়ে যেত। বাড়ির ছোট বড় সব ছেলেরা তারাবি নামাজ পড়ার জন্য সেজেগুজে মসজিদে চলে যেত। মা চাচীরা ব্যস্ত হয়ে পড়তো সেহরির আয়োজনে তারপর তারাবি নামাজ পড়ার জন্য। তখন আমাদের টিভি দেখা নিষেধ ছিল। সেহরির আগে গরম ভাত রান্না করা হতো। সেহরিতে সবাই আগে তরকারি ভাত খেত তারপর দুধ কলা দিয়ে ভাত খেতো। মসজিদে এতো বেশি ডাকাডাকি হতো আমাদের প্রায়দিনই ঘুম ভেঙে যেত। ছোটরা শুধু দুধ ভাত খেতাম। খাওয়া দাওয়ার শেষে আব্বা জোরে জোরে রোজার নিয়ত করত। আব্বার থেকে শুনে শুনেই নিয়ত মুখস্থ হয়ে গিয়ে ছিল। তখনও পুরোপুরি রোজা থাকতে পারতাম না। মা বলতো ছোটদের একদিনে তিনটা রোজা রাখতে হয়। প্রথম কবে কতো বছর বয়সে সম্পূর্ণ রোজা রেখেছি মনে নেই। তবে একটা ঘটনা স্পষ্ট মনে আছে। প্রথম যেদিন রোজা রেখেছিলাম দুপুরের পর থেকেই খুব ক্ষুধা লেগেছিল। তখন আমাদের রান্না শুরু হতো বেলা তিনটা থেকে।মা রান্না করার সময় আমাকে দাদীর ঘরের বারান্দায় একটা চৌকি পাতা ছিল সেখানে বিছানা পেতে শুয়ে রেখেছিল। পাশে দাদী বসে মজার মজার গল্প বলছিল। হঠাৎ দেখি সূর্যের ঝলমলে আলো । আসলে সূর্য পশ্চিম আকাশে যখন লাল আকার ধারণ করে, তাই দেখা আমার সেকি কান্না । আজ আর রাত হবে না– আবার সকাল হচ্ছে। সবাই আমাকে যতই বোঝাচ্ছে আমার কান্না তো থামে না। অবশেষে এলো সেই মহেন্দ্রক্ষণ ইফতারের সময়। ইফতারে বিশেষ কিছু থাকতো না। আলা চালের জাউ সঙ্গে পাট পাতার ভর্তা, ছোলা মুড়ি, পিয়াজু, বিভিন্ন মৌসুমি ফল আর আখের গুড়ের লেবুপাতার সরবত। কারণ সবাই রাতের খাবার খেয়ে তারাবি নামাজ পড়তে যেত।
রোজার দিনে আমাদের পড়াশোনার কোন চাপ থাকতো না। তবে সকালে মসজিদে আরবি পড়া বাধ্যতামূলক ছিল। আমাদের মধ্যেও প্রতিযোগিতা হতো কে কয় পাতা পড়তে পারে। একটু বড় হলে কে আগে কুরআন খতম দিতে পারে। যেদিন রোজা রাখতাম সারাদিন যে কতকিছু যোগাড় করে রাখতাম ইফতারে খাবো বলে। কুশি পেয়ারা, বড়ই, তেঁতুল, কাঁচা আম আরও কতো কি! কিছুই খাওয়া হতো না,পরেরদিন সব ফেলে দিতাম। আমি বেশি রোজা রাখতে পারতাম না অসুস্থ হয়ে যেতাম। সেজন্য আব্বা আমাকে রোজা রাখতে দিতো না। আমার খাবার জিনিসের চেয়ে না খাবারের তালিকা বেশি লম্বা ছিল। সেজন্য ভাইবোনরা সবাই আমাকে ক্ষ্যাপাতো , সারাবছর শোনা যায় মনি কিছু খায় না কিন্তু রোজা আসলে রোজা রাখতে পারে না।
রোজার শেষ দশদিন আমার মেজ দাদু মসজিদে ইতেকাফে বসতো। বাড়ি বাড়ি ইফতারি দেওয়ার দায়িত্ব মা- চাচিদের থাকলেও মসজিদে ইফতারি দেওয়ার দায়িত্ব চাচাদের সাথে ভাই- বোনদের উপর ছিল। কদরের রাতে সারারাত মসজিদে কেউ না কেউ নামাজ পড়তো। বাড়িটা তখন গমগম করতো। আমরা ছোটরাও কম যেতাম না ইফতারের পর সবাই মিলে নদীতে গোসল করে ভালো জামাকাপড় পড়ে যে যা দোয়া পারতাম ও নামাজ পড়তাম। তারপর দুহাত ভরে মেহেদী নিতাম। তখনও টিউব মেহেদী ছিল না। আমরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে মেহেদী পাতা যোগাড় করতাম। সবাই মিলে পাটায় পিষতাম। আটাশ রমজান ছিল আমাদের অপেক্ষার দিন। ঐদিন ঢাকার চাচা- চাচিরা বাড়িতে আসতো ঈদ করতে সঙ্গে নিয়ে আসতো একই রকমের গজ কাপড়। মা রাত জেগে আমাদের জন্য সুন্দর সুন্দর জামা তৈরি করতো। কি যে উত্তেজনায় কাটতো সেই সব রাত।চুড়ি, কানের দুল,ক্লিব,নেলপলিস সব এক খালার কাছ থেকে দাদী কিনে দিতো। তারপর ঈদের চাঁদ দেখা, রেডিও টিভিতে ও মন রমজানে ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ – এই গানটা শুনলেই ঈদ শুরু হয়ে যেত। খুব ভোরে দলবেঁধে নদীতে কসকো সাবান দিয়ে গোসল করে নতুন জামা পড়া।আহা! কি মধুর দিন ছিল। এখন স্বপ্নের মতো লাগে।
আমার জীবনের লক্ষ্য ছিল মায়ের মতো আদর্শ মা হওয়া। মাকে আমার সুপারম্যান মনে হতো সব পারে। এতো কাজ করেও সবসময় হাসিখুশি থাকতো কি করে! ঈদের দিন ফজর নামাজের পর সব মুসল্লীদের খিচুড়ি আর সেমাই খাওয়ানোর নিয়ম ছিল এখনো আছে। সেজন্য শেষ রাতে উঠে মা চাচীরা এসব তৈরি করতো। তারপরেও সবাই ঈদগাঁয়ে যাওয়ার আগেই মার গোসল করে নতুন শাড়ি পড়া হয়ে যেত। সবাই আমার মা – বাবার জন্য দোয়া করবেন। আল্লাহ তালা যেন উনাদেরকে সুস্থতা সহ নেক হায়াত দান করে। দাদীর একটা ম্যাজিক আলমারি ছিল। সব নাতিনাতনিদের সব আবদার মিটাতো ঐ আলমারির মধ্যে থেকে। ১৯৯৪ সালে ৩রা রমজানে ফজর নামাজের পর জায়নামাজের উপর দাদী আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যান। তার চল্লিশ দিন আগে আমার মেজ চাচা মারা যান।দাদা ও আর আমাদের মাঝে নেই। আল্লাহ তালা যেন দাদা-দাদি ও চাচাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন।আমিন।
এখন আমি নিজেই মা হয়ে গেছি। সবকিছু খেতে পারি, সব রোজা রাখতে পারি। নিজেই সেহরি,ইফতারি তৈরি করি। কিন্তু সেই আগের মজা আর পাই না। আমাদের বাড়িটাও আর আগের মতো নেই। যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার হয়ে গেছে। সব একতালা দোতলা বিল্ডিং হয়ে গেছে। মসজিদটাও দোতলা হয়ে গেছে। এখনো বাড়ি গেলে সেই শৈশবকে খুঁজে ফিরি। আহা! কি মজার দিন ছিল।
ফারহানা জেসমিন মনি- কবিও সাহিত্যিক।