হঠাৎ করেই নীলার সঙ্গে দেখা হলো আমার। ভেবে উঠতে পারি নাই তাকে ভাবী বলে সম্বোধন করবো নাকি আপু।
যাই হোক, চোখ দুটো কেমন ফোলা ফোলা যেন নেশা করে এসেছে। নীড় হারা পাখির মতো গায়ে জীর্ণশীর্ণ কাপড়। মনে হয় পুরো মাস ধরে মাথায় চিরুনি পড়েনি এমনই নাজেহাল চুলের অবস্থা। একেবারে কাকের বাসা হয়ে আছে। আমি কিছু জানতে চাওয়ার আগেই সে হু হু করে কেঁদে আমাকে জড়িয়ে ধরলো আর বললো আমি ভাল নাই রে আমি ভালো নাই। জীবনে বুঝি কোন দিনই আমার সুখ হবে না। সারা জীবন শুধু সুখের পেছনেই ছুটলাম। আর বিনিময়ে শুধু কষ্টই পেলাম রে। ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না আজ তার কেন এমন বেহাল দশা। যেন খাঁচা থেকে পাখি পালিয়ে এসেছে এমনই ভাবে ছটফট করছে সে। এখন তো সে সুখের ঠিকানায় আছে আমরা সবাই তো সেটাই জানি। কিন্তু না মোটেও সে সুখে নেই, সুখ এক আপেক্ষিক বস্তু তাই সে যতবার সুখকে ধরতে যায় ততোবারই তার খাঁচা থেকে হাত ছানি দিয়ে পালিয়ে যায়। ফলাফল রয়ে যায় তার খাতায় শূন্য। অভাগীর কপাল বুঝি এভাবেই পুড়ে। কেউ ভোগ করে আর কেউ ভোগে পড়ে।
সংসারে দোলাচল বৃত্তি এক কমন ব্যাপার।
তবে সেটা ছেলেদের ক্ষেত্রে আর মেয়েদের ক্ষেত্রে হলে এটা অস্বাভাবিক। কারণ পুরুষশাসিত সমাজ বলে কথা। পর্দা তো শুধু মেয়েদের জন্য তাই না হোক না সেটা বাহিরের বা মনের। যত আনন্দ ফুর্তি সবটুকু উঠানো থাকে সমাজে ছেলেদের জন্য।
যাক, সেসব অন্য কথা যেটা বলছিলাম।
“নীলা” হ্যাঁ গল্পের নায়িকা নীলা।
গ্রামের প্রকৃতির মতো সহজ, সরল শরৎ এর মতো প্রাণবন্ত একটি মেয়ে। অথচ আজ পাঁচ বছর ধরে তার স্বামীর সাথে মধুর বৈবাহিক সম্পর্ক নাই।
এই রকম দোলাচল বৃত্তি স্বামীর কি শাস্তি হওয়া উচিত তা গল্পের শেষে আপনারাই ঠিক করবেন। যা বলছিলাম, নীলা তার মায়ের পাতানো ভাইয়ের বাড়িতে মাঝে মাঝেই বেড়াতে আসতো। প্রানবন্ত মেয়েতো তাই বেড়াতে এসে ঘরে বসে থাকতো না। মামাতো বোনদের সঙ্গে পাড়ায় ঘুরে বেড়াতো। এই সুযোগে তাকে একদিন দেখে ফেলে হাসান। হাসানের পরিচয়টা দিয়ে ফেলি। মামার পাড়ার ছেলে। পড়াশুনা হয়তো এইচ, এস, সি পর্যন্ত। তবে ঢাকায় গার্মেন্টস এ চাকরি করে। বাবা কৃষক, টুকিটাকি জমিজমা আছে হয়তো বাবার একমাত্র ছেলে ভাবই আলাদা। মেয়ে পটানোতে পাটুয়ারী।
যাইহোক, নীলাকে দেখার পর সে উন্মাদের মতো করে। তাকে না পেলে সে পাগল হয়ে যাবে। বার বার ছুটে যায় নীলার বাড়ি দেখা করতে। নীলারা দুই বোন এক ভাই ও মেজ। বড়বোনের বিয়ে হয়েছে। রাস্তা তো পাঁকা হয়েই গেছে। নীলা সহজ-সরল মেয়ে সে ভেবেছিল সত্যি সত্যি হাসান হয়তো তাকে ভালোবাসে নয়তো কোন ছেলে একটা মেয়ের জন্য এতো পাগলামি করে। যদিও অভিভাবকরা কেউই রাজি ছিল না। এদিকে হাসান নীলাকে না পেলে আত্মহত্যা করবে বলে বাড়িতে জানিয়ে দেয়। সবাই কথার কথা বলে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। নীলাকেও তার বাবা বাড়ি থেকে আর বের হতে দেয় না। লোকে মুখে নানা কথা শোনা যায়। কলঙ্ক লাগতে তো মেয়েদের খুব বেশি সময় লাগে না। তাই সে বাবার কথা মত বাড়ি থেকে তেমন একটা বের হয় না। যদিও হাসানের জন্য তার মনে যথেষ্ট ভালোবাসার একটা জায়গা তৈরি হয়েছে।
তবুও সে নিরুপায় সমাজে তার হাত-পা বাঁধা। এ যেন শিকল ভেঙ্গে উড়তে চায় পাখি ডানা মেলে। হাসান নীলার পাড়ায় আসে তাকে এক নজর দেখার জন্য। কিন্তু দেখতে না পেয়ে হতাশায় ফিরে যায় ঘরে।
বাবা মাকে বোঝায় কিন্তু রাজি হয় না।
পরিশেষে সে সিদ্ধান্ত নিল নীলাকে ছাড়া তার জীবন অসম্পূর্ণ। যে জীবনে নীলা নেই সেই জীবন রাখাটাই নিষ্প্রয়োজন। সকালে হাসানের মা দরজায় ডাকাডাকি করে— কিরে হাসান ওঠ, বেলা হয়ে গেছে উঠবিনা, কিসের ঘুম ঘুমাস। কিন্তু হাসানের কোন সাড়া নেই।
রাজিয়া সুলতানা – কবি, সাহিত্যিক ও সহ সম্পাদক চেতনা বিডি ডটকম।