আমাদের দেশ ষড় ঋতুর দেশ। রূপ লাবণ্যে সাজানো ঋতু বৈচিত্র্যের দেশ। বছরের বিভিন্ন সময়ে সকল ঋতু তার আপন রূপ নিয়ে সাজিয়ে তোলে প্রকৃতিকে। এমনই এক নব রূপে নিজেকে সাজিয়ে,শীত কে বিদায় জানিয়ে, বসন্ত আসে আমাদের কাছে। আমার প্রিয় ঋতু বসন্ত।
আমার কাছে বসন্ত মানে প্রকৃতির মাঝে ঘুমিয়ে থাকা সৌন্দর্য হঠাৎ করে জেগে ওঠা প্রান। বসন্তের রূপ বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্য আমার মনকে সব সময় টেনে নিয়ে যায় আমার সেই ছেলেবেলায়। শীত যায় বসন্ত আসে, বসন্ত মানুষের কাছে ধরা দেয় ঋতুরাজ রূপে। বসন্তের রূপের সত্যিই কোন তুলনা নেই। শীতের জীর্ণ সাজ ফেলে দিয়ে আমাদের প্রকৃতি নব রূপে হাতছানি দেয়।
আমি হারিয়ে যাই আমার স্নেহমাখা ছেলেবেলায়। আমার মায়ের গরম চাদরের ওম থেকে আমি বেড়িয়ে পরি বসন্তের নব আনন্দে। শীতের উত্তরা হাওয়াকে পেছনে ফেলে দখিনা বাতাসে আমার মন নেঁচে ওঠে। মনপ্রাণ দুলে ওঠে বসন্তের আবেসে।
আমার মন হারিয়ে যায় পাতাঝরা বাশ বাগানে, মনে হয় বাঁশপাতার গালিচা যেখানে আমি ছোটবেলায় হাজারবার গড়াগড়ি করে খেলেছি। গাব গাছের কচি লাল লাল নতুন পাতা আমি চিবিয়ে খেয়েছি। আর বসন্তের ঝিরিঝিরি বাতাসে আমার মন খেলা করেছে।
বসন্তের আগমনে গাছে গাছে পলাশ আর শিমুল ফুলের আগুন ঝরা রঙ যেন খুশির ডালা মেলে ধরছে। আমি হারিয়ে গিয়েছি সেই মাটিতে পরে থাকা শিমুল ফুলের মাঝে। মোটা সুই সুতোয় শিমুল ফুলের মালা গেঁথে গলায় পরে খেলার সাথীরা মিলে মিশে একাকার হয়েছি। আমার গাঁয়ের মানুষ যেটাকে বলে মান্দার ফুল। আমার মান্দার ফুল আমার অঙ্গে মেখে আমি বসন্তকে বরণ করেছি।
আমার বসন্ত বিলাস কোকিলের কুহুকুহ ডাকে মুখরিত হয়েছে। আমি কোকিলের সাথে সুর মিলিয়ে হাজার বার কুহুকুহু করেছি। বসন্তে আমার বাড়ির আঙ্গিনায় আমের মুকুলের মৌ মৌ গন্ধে চারপাশ মুখরিত হয়েছে। সজনে ফুলের মৃদু গন্ধ আর গাছে গাছে নতুন পাতা পাখিদের কলকাকলীতে ভরপুর আমার শোবার ঘর যেন বসন্ত রঙে সেজেছে।
আমার কাছে বসন্তের আগমন যেন ফসলি ক্ষেতের চৌচির মাঠের মতো , কৃষকের ফেটে যাওয়া পায়ের গোড়ালি, ইটের খোয়া দিয়ে পরিষ্কার করে ,শীতকে বিদায় দিয়ে বসন্ত বরণ করা। অনেক দিন পর গ্রামের মহিলারা গায়ের গরম কাপড় ফেলে দিয়ে একটু খানি সাবান মেখে নিজের শরীর খানা পরিস্কার করে যেন বসন্তকে জানান দেয় ,বসন্ত তোমার আগমনী আমরা এবার বরণ করবো এই মিষ্টি রোদে শরীর ভিজিয়ে।
আমার বসন্ত বিলাস মানে নবীন আনন্দে জীবনের হৃদয় দুয়ার খুলে প্রকৃতির সাথে মিলে মিশে একাকার হওয়া। সকাল থেকে যেন কোকিলের সুমধুর কলতান বারবার বসন্তের আগমনের ঘোষণা করে যায়।বসন্তের মাধুরী ভেসে আসে পলাশের বাহারে, পারুলের হিল্লোলে আর বসন্তের দখিনা বাতাসে।
অবশেষে আমার বসন্ত বিলাস সকল অপেক্ষা শেষ করে শীতার্ত প্রকৃতির ঘুম ভাঙিয়ে আসে আমার প্রিয় ঋতু বসন্ত। চৈত্রের শেষ পর্যন্ত তার রুপ বৈচিত্র্য অবস্থান করে। এসময় বাংলার প্রকৃতি সত্যিই হয়ে ওঠে ঋতুরাজ বসন্তের রঙিন চাদরে ঘেরা।
প্রকৃতি যেন নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে ,করে বসন্তের রঙিন উৎসব। ঋতুর এমন লীলা বৈচিত্রের দৃষ্টান্ত পৃথিবীর অন্য কোনো প্রান্তে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত ,এই ছয় ঋতুর নানা রূপের মিলনে প্রকৃতির এই অপরূপ সজ্জা সত্যিই বিস্ময়কর।
ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল
ডালে ডালে পুঞ্জিত আম্রমুকুল।
শীতের পাতাঝরার দিনের সন্ধেবেলার মন খারাপকে কাটিয়ে উঠতে উঠতে বসন্ত যে কখন আমাদের মাঝে প্রবেশ করে, তা টের পেতেই বেশ খানিকটা সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। শীতের সাথে গ্রীষ্মের তেমনভাবে রুপগত পার্থক্য বিশেষভাবে না থাকলেও স্বরূপে তারা ভিন্ন। শীতের মধ্যে রয়েছে এক বিষণ্ণতার স্পর্শ, আর গ্রীষ্মের রূপ অতি কঠিন কঠোর। অন্যদিকে বসন্ত তার একদম বিপরীত।
বসন্তের মধ্যে রয়েছে তারুণ্য ও যৌবনের চঞ্চলতা। শীত যখন প্রকৃতির সমস্ত রস নিজের মধ্যে শুষে প্রকৃতিকে রিক্ত করে দেয়, ঠিক তখনই বসন্ত এসে তার দক্ষিন খোলা জানালা আমাদের সামনে উন্মুক্ত করে দেয়।
দীর্ঘ দুইমাস ব্যাপী রুক্ষ, শুষ্ক ও জীর্ণ বিষন্নতার এই রূপ হঠাৎ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রাণের আঙিনায় ঝড় তোলে এক অদ্ভুত উন্মাদনা। ঋতুরাজকে বরণ করে নেওয়ার মনোবাসনায় প্রকৃতি যেন পাগল হয়ে ওঠে চারিদিকে ফুল ফোটানোর আদিম নেশায়।
আমার বসন্ত বিলাস আমার শৈশব, কৈশোর, আর যৌবনকে ঘিরে। শৈশবে আমি মায়ের গন্ধ মাখা চাদরের মাঝ থেকে বেরিয়ে ছুটে গিয়েছি মান্দারের ফুল( শিমুল ফুল) কুড়োতে। আর কৈশোরে খুঁজে নিয়েছি আমার মায়া ভরা গ্রামের আমের মুকুল, সজনে ফুলের সুভাষ ,বাঁশ বাগান ,আর পাতাঝরা গাছের নরম কচি পাতার স্পর্শ । আর যৌবনে পেয়েছি বসন্তের নতুন উম্মোদনা, নিজের মাঝে নতুন কিছু খুঁজে পাওয়া, মন খারাপের কষ্ট ভুলে আনন্দের ডালি সাজানো ।
ইসরাত জাহান – কবি ও সাহিত্যিক।