বাবা, মা আর জিসান এক সাথে খাবার টেবিলে, প্রায় দুইমাস পর জিসান বাবা মায়ের সাথে খেতে বসেছে। কারণ জিসান
সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত বাবা মায়ের সাথে ছিলো।তারপর ক্যাটেড কলেজে ভর্তি। সেই থেকে জিসানের অন্য জীবন,চাইলেও বাসায় ফিরতে পারে না। তাছাড়া বাবা মা দুজনেই চাকরি করে অনেক ব্যস্ত তারা। জিসান বাসায় থাকলেও তো সারাক্ষণ কাজের মানুষের কাছেই থাকতে হতো। জিসানের দাদা বাড়ি, নানা বাড়ি খুব একটা বেশি চেনা জানা হয়নি। দাদা, দাদী, নানা নানী বাসায় বেড়াতে আসলে যতোটুকু সময় তাদের সাথে কাটিয়েছে।
গত বছর দাদী হঠাৎ করে স্ট্রোক করে মারা গেল, কিন্তু জিসানের আর যাওয়া হলো না। খুব মন খারাপ হয়েছিল ,দাদীর কথা বার বার মনে পড়েছিল। জিসান বাবা মায়ের কাছ থেকে দাদা দাদীর কথা পৃথক করে কখনও কিছু শুনে নাই। যেটুকু শুনেছে সেটা হলো বাবা ফোন করে যখন খবর নিত, তারা কেমন আছে? প্রেসার , ডায়াবেটিস ঠিক আছে কিনা, টাকা লাগবে কিনা ইত্যাদি বিষয়। আর জিসানের ফুপি সে তো থাকে কানাডায়।
দাদীর কবর যিয়ারত করার জন্য বাবা মায়ের সাথে জিসান দাদা বাড়িতে গিয়েছিল। এবার বনমালিপুর এসে জিসানের খুব মন খারাপ, দাদী নেই বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে। সারা বাড়িতে দাদা একলা বসবাস করে, এসব দেখেও জিসানের খুব কষ্ট হয়েছিল। জিসানের বাবা অনেক বার দাদাকে বলছে ঢাকায় যেতে। কিন্তু দাদা গ্রামে অনেক ভালো আছে চারপাশে অনেক লোকজন সবাইকে নিয়ে মানষিক প্রশান্তিতে আছে। এবার দাদার সাথে জিসানের খুব ভালো সময় কেটে গেল।
জিসান পনের দিনের ছুটিতে ঢাকাতে এসেছে। আজ খাবার টেবিলে বাবা মা দুজনেই জিসানকে বললো দাদা আজ ঢাকাতে আসবে কয়েকদিনের জন্য, তোমার সাথে থাকবে। বাবার বয়স হয়ে গেছে অযথা অনেক কথা বলে তুমি একটু মানিয়ে নিও। আর স্কুল শিক্ষকরা রিটায়ার্ড করার পর খুব বেশি নিঃসঙ্গ অনুভব করে। তারপর দাদী মারা যাবার পর কিন্তু দাদা আরও বেশি একাকি হয়ে পড়েছে।
বাকিটা বুয়া সামলে নেবে। দাদা যা যা জিজ্ঞেস করে উত্তর দেবে ল্যাপটপ আর মোবাইল নিয়ে মগ্ন থেকো না দাদা কষ্ট পাবে। জিসান কথাগুলো কতোটা শুনলো, বাবা মা ঠিকঠাক বুঝতে পারলো না। বাবা জুতার ফিতা বাঁধতে বাঁধতে আরও বললো, জিসান দাদা আসার পর দরজা খুলে দিয়েই নিজের রুমে চলে যেও না। দাদাকে বসতে দিয়ে একটু কুশলাদি জিজ্ঞেস করো।
জিসানের বাবা মা অফিস যাবার কিছুক্ষণ পরই দাদা এসে হাজির। জিসান দাদার কুশলাদি জিজ্ঞেস করে,দাদাকে বসতে দিয়ে নিজের রুমে গিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে
নিজের মতো করে আছে। সারা রুম এলোমেলো এটা সেটা ছড়ানো ছিটানো দরজা জানালা বন্ধ জিসান অনেক সাউন্ড দিয়ে গান শুনছে। দাদা হাত মুখ ধুয়ে অজু করে যোহরের নামাজ পড়ে, আস্তে করে দরজা ঠেলে ভেতরে গিয়ে জিসানকে বললো দাদুভাই চলো দুজন খেতে যাই। জিসান হেডফোন কানে কিচ্ছু শুনতে পেল না। দাদা জিসানের পিঠে হাত দিতে জিসান হেড ফোন খুলে দাদাকে বসতে বললো। দাদা জিসানের ল্যাপটপ থেকে বিভিন্ন
কিছু বের করে দেখাতে বলছে, জিসান খুব অবাক তুমি এতো সব জানো কিভাবে? দাদা বললো আমার এক ছাত্র আমাকে একটা ল্যাপটপ উপহার দিয়েছে এবং অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়েছে। তাই বিভিন্ন বিষয় জানতে পারছি প্রতিদিন।
তারপর দুজন একসাথে খাবার টেবিলে বসে খেতে খেতে ,দাদা প্রশ্ন করলো দাদুভাই, হোস্টেল লাইফ কেমন লাগছে তোমার? ওখানে পঠিত বইয়ের বাইরে আর কি কি বই পড়ছো? কি গান শোন, সিনেমা দেখ কি না ইত্যাদি প্রশ্ন করে চলেছেন দাদা। জিসান খুব অবাক তুমি এতো সব বই পড়েছো, এই গান তুমি শোন!!
জিসান পুরো বোবা হয়ে যায়। এই দাদুকে তো ও চেনে না। বাবা মা একটি কথাও কোনদিন এসব নিয়ে বলে নি কখনো দাদুর ব্যাপারে। তারা কি আদৌও জানে দাদুকে? তুমি সারাদিন কি করো দাদু বনমালিপুরে? দাদা খুব সুন্দর করে বলছে বাড়ির কাজ করি, বাড়ির চারপাশের বাগান পরিচর্যা করি, বাচ্চাদর পড়াই, বই পড়ি, গান শুনি, ইউটিউবে অনেক বড় বড় বক্তার ওয়াজ শুনি এই তো চলে যাচ্ছে দিন।
জিসানের সাথে দাদার অনেক সুন্দর সময় কাটছৈ। জিসানের একবারও মনে হচ্ছে না দাদা গ্রামে থাকে কিচ্ছু বোঝে না। বার বার মনে হচ্ছে বাবা মা তাঁকে ভালো করে চিনতেই দেয়নি দাদাকে। দুজন ঢাকা শহরের অনেক জায়গায় একসাথে ঘুরছে, কেনাকাটা করছে,নতুন নতূন বই কিনছে।জিসান দাদাকে নিয়ে খূব আনন্দ করছে।জিসানের বন্ধুদের সাথে পরিচয় করে দিয়েছে।
জিসান তার প্রথম দিনের ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়ে দাদার সাথে কিভাবে ক’টা দিন কাটিয়ে দিলো নিজেও জানেনা। জিসানের ছুটি শেষ দুজনেরই মন খারাপ। বিদায়ের পালা দাদা একদিকে, জিসান অন্যদিকে।ঢাকার তিনতলা বাসাটা একদম খালি।
জিসান বাবা মায়ের সাথে গাড়িতে উঠবে , ঠিক সেই সময় দাদা একখানা চিঠি দিয়ে বললো গাড়িতে বসে পড়বে। জিসান চিঠিটা হাতে নিয়ে দাদার চলে যাওয়াটা, অপলক দৃষ্টিতে দেখে নিল।
কিছুদুর গিয়ে জিসান চিঠিটা খুলে দেখলো কি লিখেছে দাদা….
দাদুভাই,
মানুষ শেষ বয়সে এসে লোভী হয়ে পরে।আমার আত্মজ কে দেখতেই আমি এবার অসুস্থ শরীর নিয়ে ঢাকাতে আসি। আমি বেঁচে থাকবো তোমার মধ্যে দাদুভাই। তাই তোমাকে চিনতে ,জানতে এসেছিলাম।আমি তৃপ্ত ,আমার আর কোনো আক্ষেপ নেই। আমি আর বেশিদিন নেই ,তোমার মধ্যে বেঁচে থাকতে চাই।
আমার একলা আকাশ থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে,শুধু তোমায় ভালোবেসে……
চোখ ছলছল করে ওঠে জিসানের।
বাঁচতে তোমাকে হবেই দাদু ,আমার জন্য।
জেনারেশন গ্যাপ কি সুন্দর ভাবে পূর্ণ হয়ে যায় ছোটবেলার শূন্যস্থান পূরণ করার মত
…
ইসরাত জাহান – কবি ও সাহিত্যিক।