নার্গিসের সঙ্গে বিয়ে ভেঙে যাওয়ার প্রায় সাড়ে তিন বছর পর কুমিল্লার আশালতা সেনগুপ্তা ওরফে প্রমীলার সঙ্গে নজরুল বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। নজরুলের মাতৃসমতুল্য বিরোজা সুন্দরী দেবীর ‘জা‘ গিরিবালা দেবীর কন্যাই হলেন আশালতা সেনগুপ্তা ওরফে প্রমীলা দেবী। সে সময়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতার জন্য নজরুলের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বের হলে নজরুল কুমিল্লায় চলে আসেন। এখান থেকে তার প্রেম ও দ্বিতীয় বিয়ের সূত্রপাত ঘটে। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৫ এপ্রিল শুক্রবার বাদ জুমা কলকাতার ৬ নাম্বার হাজী লেনের বাসায় তাদের বিবাহ সম্পন্ন হয়। ধর্মীয় বিধান মোতাবেক কবি নজরুলের বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল। কাজী নিযুক্ত হয়েছিলেন মৌলভী মঈন উদ্দীন হোসেন। এক হাজার টাকা দেনমোহরে বিবাহ সম্পন্ন হয়। কাবিননামায় শর্ত ছিল প্রমীলা ইচ্ছা করলে মুসলমান হতেও পারেন বা ইচ্ছা না করলে নাও হতে পারেন। এতে কারো কোনো বাধা নেই। ধর্মমত অনুসারে জোর–জবরদস্তি নেই। প্রমীলার সঙ্গে বিবাহের পর মুসলমান সমাজ যতটা নজরুলকে ঘৃণা করেছেন তেমনি ঘৃণা করেছেন হিন্দু সমাজও। মাতৃসম বিরজা সুন্দরী দেবী নজরুল প্রমীলার বিয়ে মেনে নিতে পারেননি। প্রমীলাকে বিয়ে করার কারণে ‘প্রবাসীতে‘ও নজরুলের লেখা প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। নজরুল প্রমীলার বিবাহিত জীবন ছিল ৩৮ বছরের মতো (১৯২৪–১৯৬২ খ্রিস্টাব্দ)। নজরুল সুস্থ অবস্থায় চার পুত্র সন্তানের জনক ছিলেন। নজরুল অকস্মাৎ বাকরুদ্ধ হন ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১০ জুলাই নজরুলের প্রথম পুত্র কৃষ্ণ মোহাম্মদ ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং ওই বছরই ডিসেম্বর মাসে অকালে মৃত্যুবরণ করেন। তার দ্বিতীয় পুত্র অরিন্দম খালেদ (বুলবুল) জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে এবং মারা যায় ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে। নজরুল ইসলামের ৪ বছরের শিশুপুত্র অরিন্দম খালেদ বুলবুল বিনা চিকিৎসায় বসন্ত রোগে মারা যায়। তাকে দাফন করার জন্য নজরুল তার লেখার পাওনা টাকাও আদায় করতে পারেননি। নজরুলের বড় ছেলে কাজী অনিরুদ্ধ নির্মম হান্মোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বাংলা ১০ ফাল্গুন ১৩৮০ বঙ্গাব্দ শুক্রবার সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে মারা যান। নজরুলের ছোট ছেলে কাজী সব্যসাচী ১৯৭৯ সালে মারা যান।
১৯৩৯ সালে নজরুলের স্ত্রী প্রমীলা পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হন। স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করেও কোনো লাভ হয়নি। নজরুলের দুঃসময় জীবনের অন্যতম এক অধ্যায় প্রিয়তমা পত্নী প্রমীলার অসুস্থ হওয়া। নজরুল তার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য যে যা বলেছেন তাই করেছেন। স্ত্রীর চিকিৎসার ব্যয় নির্বাহের জন্য নজরুল তার বালিগঞ্জের জমিটুকু পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছিলেন।
১৯৪২ সালে কবি নজরুল নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘকাল ডাক্তাররা তার রোগ ধরতে পারেননি। ১৯৫২ সালে নজরুল নিরাময় সমিতি গঠিত হয় কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তির চেষ্টায়। ১৯৫৩ সালের ১০ মে তারিখে লন্ডনে পাঠানো হয় নজরুলকে। সেখানে তার রোগ ধরা পড়ে। এ রোগের বৈশিষ্ট্য হলো মস্তিষ্কের সামনে ও পাশের অংশগুলো সংকুচিত হয়ে পড়লে রোগী শিশুর মতো আচরণ করতে থাকে। এ রোগ নিরাময় সম্ভব নয় বলে ডাক্তাররা জানান। ১৯৬২ সালের ৩০ জুন দীর্ঘ রোগভোগের পর নজরুলের প্রিয়তমা পত্নী প্রমীলা সেনগুপ্ত মারা যান। নজরুল তখন নির্বাক, নিস্তব্ধ, বাকহারা। কবিপত্নী সমাহিত হন চুরুলিয়ার মাটিতে।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আগ্রহে নজরুলকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। নজরুলকে সম্মান জানিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে ‘জগত্তাড়িনী‘ পদকে ভূষিত করে। ভারত সরকার তাকে ‘পদ্মভূষণ‘ উপাধি দিয়ে সম্মান জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কবিকে সম্মানজনক ডি. লিট ডিগ্রি প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ সরকার তাকে ২১ পদকে ভূষিত করেন।
পারভীন আকতার-সহ সম্পাদক,চেতনা বিডি ডটকম