ডাকঘর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
যখন ডাকঘর পড়তে বসেছি আমার স্কুলের সেই কবেকার একটা পুচ্চি ছাত্রের মুখটা ভেসে আসে।
তারপর সত্যিই যত পড়েছি ততই অমল রুপি ওই অতটুকু ছাত্রের মুখখানা কল্পনায় আলোর স্রোতে ভেসে আসে।
সে প্রথম প্রশ্ন করেছিলো
ম্যম ঐ মেঘেদের ওপারে কি সৃষ্টিকর্তার বাড়ি আছে?
কেমন সে ই বাড়িটা,সে বাড়িতে কি সবাই যেতে পারবে?
আমিও যে যেতে চাই ঐ নীল মেঘেদের ওপারের বাড়িতে।
তাকে মৃদু হেসে বুঝিয়েছিলাম, “কীভাবে তোরে বুঝাই?”
দূরে যে সপ্ত আসমানের নীল মেঘেদের ওপারে বাড়ি সেখানে মহান সৃষ্টিকর্তা যাকে যখন পছন্দ করেন তাকেই নিয়ে যান।শুনে সে কিচ্ছুক্ষণ চুপ থেকে বলেছিলো
ম্যম আমি কবে তার পছন্দের হতে পারবো? বলুন না প্লিজ ম্যাম।
তখনই বুঝেছিলাম, তার কৌতূহল আর জানার অদম্য ইচ্ছে। যত এগুই ততই তাকে মিলিয়ে ফেলি অমলের মাঝে।
গত বছর চারেক আগে সে ও সৃষ্টিকর্তার প্রিয় হয়ে পাড়ি জমিয়েছিলো ঐ মেঘেদের ওপারের সৃষ্টিকর্তার বাড়িতে।
চোখ গড়িয়ে জল নামলো।
অমলের ব্যমোতে আক্রান্ত হওয়ায় কবিরাজ তাকে বাইরে যেতে বারণ করেছে তাই ছোট্ট জানালা দিয়ে সে রোজ বাইরের জগতের সাথে কথা বলে।প্রথমে দই ওয়ালার দই ফেরি করা তার ছোট্ট কচি মনকে মুগ্ধ করে দেয়।দই ওয়ালার দই ফেরি আর অদ্ভুদ সুরে হাক তার কচি মনকে আচ্ছন্ন করে।দই ওয়ালার সাথে কথা বিনিময়ে তার ভাব হয়ে যায়।
এর পরে প্রহরীর সাথে অমলের কথোপকথন। প্রহরী র ঘন্টার ধনিও তার কিশোরমনে প্রভাব ফেলে।প্রহরী ঘন্টা বাজানোর শব্দ ও তাকে আন্দোলিত করে গভীর বিস্ময়ে।সেও ইচ্ছে পোষণ করে ঘন্টা বাজানো শেখার।
জানালার ফাঁক গলে ঢুকে পড়া আলোর বন্যায় সে ও ভেসে যেতে চায় কল্পনার দূর পাহাড়ের ওপারে।
প্রহরী কে অমল প্রশ্ন করে জানালা দিয়ে যে নিশানা ওড়ানো বড় ঘরে কি হয়? তার ছোট্ট মনে আশা তার নামেও চিঠি আসবে!
প্রহরীর কথায় তার মনে প্রবল আশার উদ্রেক হয়
রাজা তাকে চিঠি লিখবেন ছোট্ট ছোট্ট চিঠি।সে চিঠি পাবার আনন্দে সব কষ্ট ভুলে যায়।
এরপরে একে একে মোড়ল,ফকির,সুধার সাথে তার কথোপকথন হয়।আর মনের সুপ্ত বাসনা গুলো কী সুন্দর করে ছোট্ট ছোট্ট কথায় ব্যক্ত করে ফেলে।আসলেই অদ্ভুত এক মুগ্ধতা ছোট ছোট কথাগুলোতে।
অমলের কথাগুলো বারবার পড়ে মনে হয় চোখের সামনে ফুটে উঠলো সব দৃশ্য।
শুধু বিস্মিত হয়ে ভাবি ছোট্ট ছোট্ট সহজ সরল কথায় কত্ত সুন্দর বিশ্লেষণ। সুধা শেষ কথাটিও খুব করে মনে প্রভাব ফেলে গেলো, বলোযে,সুধা তোমাকে ভোলেনি।
ডাকঘর লেখাটি ১৭ টি ভাষায় নাটকে রুপ দেওয়া হয়।
নীচের ডাকঘর নাটক নিয়ে লেখাটুকু ভীষণভাবে নাড়া,দিলো তাই সংযোজন করলাম।
পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ- এ একটি অনাথ আশ্রম ছিলো। শিশু সাহিত্যিক ও চিকিৎসক ইয়ানুস করজাক ছিলেন অনাথ আশ্রমটির পরিচালক। দখলদার নাৎসিরা তখন শুদ্ধিকরণ কর্মসূচি চালাচ্ছে। সে দেশের ইয়াহুদিদের ধরে ধরে কুখ্যাত এক্সটারমিনেশন ক্যাম্প তথা নিধন শিবিরে পাঠানো হতো। সেখানে তাদের হত্যা করা হতো।
একদিন ঐ অনাথ আশ্রমের বাচ্চাদেরও গণ নিধনের জন্য ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ডা. করজাককে চিকিৎসক হওয়ার কারণে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু তিনি রাজি হননি। বাচ্চাদের সাথে মৃত্যুবরণ করার সিদ্ধান্ত নেন। তার আশঙ্কা ছিলো মৃত্যুর আগে বাচ্চারা প্রচন্ড ভয় পাবে।
বাচ্চাদের মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “ডাকঘর” নাটকটিকে পোলিশ ভাষায় ভাষান্তর করেন। বাচ্চাদের দিয়ে নাটকটি অভিনয় করান। নিজে অভিনয় করেন রাজবৈদ্য চরিত্রে।
নাটকটি অভিনয় করিয়ে ডা. করজাক বাচ্চাদের বোঝান যে, মৃত্যু আসলে মুক্তি। এতে ভয়ের কিছু নেই। একজন মানুষ মারা গেলেই কেবল ক্ষুদ্রতা থেকে, বন্দীত্ব থেকে, পরাধীনতা থেকে মুক্তি পায়।
মৃত্যুই শেষ নয় , স্রষ্টা যদি আমাদের শুধু এই দুনিয়ার জন্য সৃষ্টি করতেন তবে মৃত্যু না দিয়েই পাঠাতে পারতেন।
“ডাকঘর” বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় দেশে দেশে মঞ্চস্থ হয়েছে। মানুষ যেন মৃত্যুকে ভয় না পেয়ে মুক্তির স্বাদ হিসেবে গ্রহণ করে, সেই শক্তি যুগিয়েছে এই নাটক।
তাওয়াব নূর- কবি ও সাহিত্যিক, পঞ্চগড়।