এখন যেমন মধ্যরাতে চাঁদ দেখার খবর আসে, আমাদের সময় এমনটি ছিলো না। ঈদের সম্ভাব্য আগের সন্ধ্যায় ছেলে বুড়ো সবাই মিলে পশ্চিমাকাশে তাকিয়ে থাকতাম- কে আগে বাঁকা কাস্তের মতো চাঁদকে দেখতে পারে। কেউ একজন দেখলেই হলো- ঐ যে চাঁদ, ঐ যে ছবুর আলীর বাঁশের ঝাড়ের মাথায়- হানেপ মোল্লার খড়ের পালার উপর দিয়ে চিকন চাঁদ সোনার লাহান চকচক করে। কিসের রেডিও কিসের টিভি? স্বচক্ষে চাঁদ দেখার মজাই আলাদা। শুরু হয় হৈ-হুল্লোর, কাল ঈদ কাল ঈদ বলে সে কি চেঁচামেচি! রাতে বিছানায় শুয়ে ঘুম আসে না, কখন সকাল হবে? ঈদের আগের রাত যেনো দুই রাতের সমান।
সকাল হওয়ার সাথে সাথে আব্বার সাথে গরু নিয়ে গাঙে চলে যাই। ঈদের দিনে ওগুলোকে পদ্মার পানিতে ঝাঁপাতেই হবে, না হলে সংসারে অমঙ্গল হয়। পানিতে নামিয়ে খড় দিয়ে ঘষে ঘষে গরুর গায়ে লেগে থাকা ময়লাগুলো পরিষ্কার করে তারপর শিং দুটো চেপে ধরে মাথাটাকে পানির নীচে চেপে ধরলেই গরুর গোসল শেষ। আমি বুছুরগুলোকে গোসল করাতাম আর আব্বা করাতেন বলদ ও গাভীগুলোকে। তারপর দুই টাকা দামের হাবিব সাবান গায়ে মেখে শুরু হতো আমাদের গোসল করার পালা। বছরে দুইবার গায়ে সাবান মাখার সুযোগ ছিলো, সেটা দুই ঈদ। কেউ মারা গেলেও দেখতাম এই হাবিব সাবান দিয়ে গোসল করাতো। বাঁকি দিনগুলোতে নদীর আঠালে মাটি দিয়ে সাবানের কাজ সারতাম। মাথার চুল আঠায় চিটচিটে হয়ে গেলে ঐ আঠালে মাটি দিয়েই তার জট ছাড়ানো হতো। আহা! ঐ মাটির কী পাগল করা গন্ধ ছিলো রে ভাই!! যা হোক, ঈদের দিন সকালে নদীর কিনার জুড়ে যতদুর চোখ যায়, শুধু গরু আর মানুষ। তবে মানুষের চেয়ে গরু অনেক বেশি।
মা টিনের প্লেট ভর্তি করে সেমাই দিতেন। খুব যতন করে সুরমা লাগিয়ে দিতেন চোখে। দূরে ঈদের মাঠ থেকে মাইকে ইমামের সময় মতো নামাজ পড়তে যাওয়ার ডাক শোনা যেতো। আমরা যখন ঈদগাহের দিকে রওনা দিয়েছি তখনো কেউ কেউ গরু নিয়ে নদীর দিকে যেতো। আমার তখনো নামাজের প্রতি অতটা দরদ পয়দা হয়নি। তাই নামাজ না পড়ে ঈদের মাঠের যেদিকে বাতাসা, সন্দেশ আর খেলনার দোকান বসতো আমি সেখানে গিয়ে ঘুরতাম। সে সময় কেউ কাউকে সেলামি দিতো না। ঈদের মাঠে যাওয়ার সময় মা দশটি দশ পয়সা দিতেন। তাই পকেটে নিয়ে মহা খুশি হয়ে ঈদগাহে যেতাম।
আমার এখনও মনে আছে দশ পয়সা দিয়ে বেলুন কিনে ফুঁ দিয়ে ফুলাতাম। বেলুনের প্যাকেডের গায়ে মুকুট পরা মানুষটির পাশে লেখা থাকতো ‘রাজা’। তখন বুঝতাম ফুঁ দিয়ে ফুলিয়ে ফটাশ করে ফাটিয়ে ফেলাই বেলুনের কাজ। অনেক পরে বুঝলাম এর আসল কার্যকারিতা।
রফিকুল্লাহ্ কালবী –
কবি ও সাহিত্যিক কুষ্টিয়া।