আমি তখন ঢাকায় সবে নতুন বাসায় উঠেছি
অভাবের চাকা ছেড়ে সুখের গতি
কেবলই বেড়েছিল দিনকে দিন।
ম্যাচে থেকে হিসেব করে খাওয়া
গোল ভাগে আলুভর্তা, বাটি করে ডাল
আরো কত কি!!
আজ নাটাইয়ের সুতো হাতে ;
সুখের ঘুড়ি করে টালমাটাল।
নতুন চাকরির কাচা টাকায়
সুখ ছিলো ; বিবেক ছিলো না কড়া পাহাড়ায়
মনে পড়ে এখনো
মায়ের আঁচল কেটে বানানো জামা
কখনো শার্ট প্যান্ট দিতো ছোট মামা
খাতার কাগজ শেষ হয়ে গেলে!!!!
অস্তিত্বের নিকষ রক্ত গুলো জেগে উঠত কোলাহলে।
মায়ের মর্মরে অন্তঃসার আর স্বল্প রোজগারে,
অভাবের পাখিরা বিচরণ করতো শূন্য কোষাগারে
মাসের মাঝখানে কলমের কালি ফুরিয়েছে তবে,
শুধু পড়া মুখস্থ রেখেছি ; অপেক্ষায় থেকেছি কলম কিনবো কবে
আজ সুখের নৌকা টলটলে জলে চলে!!
মায়ের কথা মাঝে মাঝে মনে পড়ে।
সারাদিন শেষে রোজগারের অবৈধ টাকা
গুণে গুণে ক্লান্ত ; দায়িত্ব দিতো গা ঢাকা!!
এক টাকা এক কড়ি পেতে কতো কষ্ট করেছি
পাছে কতো রাত টাকার বালিশে ঘুমিয়েছি!!
হঠাৎ মায়ের চিঠি পেলাম, খুব অসুস্থ মা!!
কাজের চাপে চিঠিটি একবার পড়েছি
পরে বাসায় ফিরে বেমালুম ভুলে গিয়েছি।
টাকার তারুণ্যে আমি সমুদ্রে ভেসেছিলাম
কিন্তু সুখের সাগরে আস্তে আস্তে নুড়ি জমছিলো
তারা খুব ই ছোট কিন্তু ছিলো শক্ত দলিল;
কিছুদিন যেতে অফিসের দরজায় দাঁড়ালো
গ্রামের বাড়ির পরিচিত ছোট ভাই ;
কেঁদেই বলল, চাচী মনে হয় আর বাঁচবে না
এক্ষুনি সাথে চলো, দাদা ভাই!!
এদিকে আমার জরুরি মিটিং, না হয়
খোয়া যেতে পারে লক্ষ টাকা।
আমার মাপের নিক্তিতে ছিলো নেশার জং
মায়ের মূল্য উড়িয়ে নিলো সাদা পাতার রং
আমি উচ্চে ভেসে রইলাম, বিলাসিতায়!
ভাইকে বিদায় করলাম সময়ের, স্বল্পতায়!
দুদিন পর যাবো বলে, গেলাম পাঁচ দিন পর
ততক্ষণে জীবন, সময়কে দিলো অগ্নিমূর্তি দর।
যবে চাপালাম, দামী গাড়ি উঠোনের কোণায়
সবে মাত্র হলো, মায়ের শেষ বিদায়!!
লোকজন হূ হূ করে আমার পাশে ভীড় করে
দেখে সব কিছুক্ষণের জন্য মনটা শূন্যতায় উড়ে
সেই আবারও, ফিরে এলাম টাকার নীড়ে
খেয়ালের স্রোতে তীর ভাঙা নদীর তীরে।
সেই যে এলাম! স্বপ্নের শহর ঢাকায়!!!
আর মনে পড়ে না, কবে গিয়েছিলাম ছোট্ট পাড়ায়!
এখন আমি আমার ঘরে কারারুদ্ধ ; যন্ত্রের মতো চলি!!
জীবনের জয় গান কন্ঠে বাকরুদ্ধ ; মন্ত্রের মতো বলি!!
কখনো কষ্ট গুলো!!!
পুরনো টিনের গেটের জং ধরা খাঁজে
খুলবে না কেউ জেনেও, বৃথা তর্কে বাজে!!
দেহের জমাট বাঁধা রক্তে গুলো, বেকার শব্দ করে
পচন ধরা অনুভূতির সরোবরে, মিথ্যে পদ্ম ফুটে!!
এখন, একাকী বৃদ্ধাশ্রমের ছোট্ট জানালায়
বিপন্ন মানবতায়, দিন গুলো কেবলই পালায়।
বিকৃত স্বান্তনা, ভূলন্ঠিত বাসনা
এখন শুধু ই পরাজিত সকালের সম্ভাবনা!!
জীবনের সব অলিগলির হিসেব গুলো
মিলিয়ে দেয় সময়ের ছোট্ট অনু
হঠাৎ দেখি!! পেপারে আমার ছবি।
আমি বৃদ্ধাশ্রমে, সেটা নিয়ে আদালতে মামলা চলে।
বাদী, ছেলেটা বাস করতো আমারই মহলে।
মামলায় পরাজিত সৈনিক ; আমার দুই ছেলে
আমায় ফিরিয়ে নিতে চায়,আদালতের কঠিন সিদ্ধান্ত বলে।
না হয় হাতে পড়বে হাত কড়া
আমি সত্যি ই এবার দিশেহারা।
লক্ষ্ লক্ষ টাকা, বাড়ি আর গাড়ি
শুধু সুখের সাথেই যেনো আড়ি।
টাকার পাহাড় গুলোতে অন্যে করে মোক্তারি
জীবনে সবকিছুই যেনো করলো ছলচাতুরী!!
কোথায় গেলো রোজগার;
হলো না আচরণের শুদ্ধি সংস্কার।
আমি আমার মায়ের বিপদগামী সন্তান
কেনো আমার প্রতি হবে, আমার সন্তানেরা যত্নবান।
আমার উপচে পড়া, বিলাসী সমুদ্রে এখন নুড়ি পাথরে ভরা
সাথে অল্প জল,শুষ্কে শুষ্কে বয়ে যাওয়া।
এগলো আমার অন্ধ জ্ঞানের সহচর
কে বলে আমার ছেলেরা অপরাধী
আমি বলি আমি সবচেয়ে বড় অপরাধী
যে অপরাধের জন্মদাতা
তাইতো বৃদ্ধাশ্রম হয়েছে আমার কুঠরী সঙ্গী
মায়ের কঠিন অসুখেও শুধরে যেতে পারিনি
ধ্যান,জ্ঞানের কঠিন অঙ্গভঙ্গি।।
নাসরিন জাহান- কবি ও সাহিত্যিক