ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় তমার ফোন এলো।শ্রী অবাকই হলো। আজ থেকে বেশ কয়েক বছর হলো ওর সঙ্গে সে ভাবে কথা হয়ে ওঠে না। সেই স্কুল পাশ করে বেরিয়েছে তখন থেকে প্রায় দেখা শোনা বন্ধ। আর কথা না বলার কারন রয়েছে। ইচ্ছে না হলেও ফোন টা রিসিভ করতেই হলো। অপর দিক থেকে ভেসে এলো- শ্রী বলছিস?
চিনতে পারলি আমাকে? কিছু কথা ছিল তোর সঙ্গে, সময় হবে?
শ্রী – চেনা মানুষ কি ভুল হয়? প্রিয় বন্ধুদের মধ্যে তুই এক জন । আজ কয়েক বছর হচ্ছে একে অপরের থেকে দূরে । তবে মনে তো রয়ে গেছিস তোরা। বল কি বলতে কল করেছিস?
তমা-এই পূজার অষ্টমীতে আমাদের পুরো টিম মানে সব বন্ধুরা সারারাত জেগে ঠাকুর দেখা আর জমিয়ে আড্ডা,খাওয়া দাওয়ার পরিকল্পনা করেছি, খুব মজা হবে। তোকেও থাকতে হবে।
শ্রী- মানে এই বছর কি সব্বাই কলকাতা তে, আমি এতুটুকুও জানতে পারলাম না। মানে অর্নব, রাহুল, রিনীত, অর্না, সৃজা সবাই এখানে।
তমা-হা বাবা সব এখানে, আসলেই দেখবি। কফিহাওসের সামনে আগে সবাই জড়ো হবো।তার পর সব পরিকল্পনা।
শ্রী- ঠিক আছে সময় মতো পৌঁছে যাবো। বলতেই ফোন কেটে গেল। মনে মনে বললাম আজ পাঁচ বছর পর সবার সঙ্গে দেখা হবে। আর ওর সামনা সামনিও হব পাঁচ পাঁচটি বছর পর। যেদিন আমাদের প্রায় পাঁচ বছরের ভালোবাসা কে ভুলে তমার হাতে হাত রেখে আমার চোখের সামনে থেকে নতুন করে পথ চলা শুরু করেছিল। কষ্ট যন্ত্রণা ক্ষোভ কাকে বলে সেদিন বুঝেছিলাম। মাঝে এই দীর্ঘ সময় সে কষ্ট আজ অনেক সহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে। নতুন করে কষ্ট দিতে কি আবার ফিরে এসেছে? ।জানি ও খুব সুখে আছে নতুন ভালোবাসা পেয়ে।
এখান থেকে মন সরিয়ে অন্য কাজে লেগে পড়ল শ্রী।
অষ্টমীর দিন সন্ধ্যায় যথারীতি সেজেগুজে কফিহাওসের পথে পা বাড়ালো। একটা উত্তেজনা অনুভব করল। এতোদিন পর সবার সঙ্গে দেখা । নিশ্চয় সবাই খুব ভালো আছে।
শ্রী সাড়ে সাতটাই কফিহাওসের সামনে। প্রায় সবাই এসে গেছে, শুধু তমা আর অর্নব এখনো এসে পৌঁছায় নি । এতো দিন পর সবাই সবাইকে পেয়ে খুব বেশি খুশি। সবাই যেন সেই বয়সে ফিরে এসেছে। সেই সারল্যের হাসি ভরা মুখ। দশ মিনিটের মধ্যে অর্নব আর তমা এলো। এদের জুটি টা আমার বেশ ভালো লাগছে। আমি অর্নবের কাছে সত্যি বেমানান ছিলাম। তমা এসে সবার উদ্দেশ্যে বললো- বন্ধুগণ এই রাস্তায় কোনো কথা নয়, আমরা কোনো রেস্টুরেন্টে এ গিয়ে বসে খেতে খেতে আড্ডা দিতে থাকি। আজ একটা চমক অপেক্ষা করছে সবার জন্য।
রিনিত- চমক সেটা কিসের?
তমা- আছে আছে বস অপেক্ষা করুন।
অর্না- তমা তুই বরাবর এমন ধোঁয়াশা রেখে কথা বলিস। খুলে বল কি হয়েছে?
তমা- ঠিক আছে আমরা খাওয়া শুরু করেই বলবো।
সবাই একটি রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলাম। সবাই টেবিলে গিয়ে বসে আড্ডা শুরু করল,শ্রী ধীর পায়ে সবচেয়ে কোনের টেবিলে গিয়ে বসলো। চার জনের টেবিলে শ্রী একাই। একবার চোখ তুলে চারদিকে তাকিয়ে নিলো, অর্নব কে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তমা একবার মুখ তুলে শ্রীর দিকে চেয়ে মুচকি হেসে আবার আড্ডায় ফিরে গেল। শ্রী একটু বেশি চুপচাপ হয়ে গিয়েছে কারো সঙ্গে কথায় বলতে পারছে না। নিজের খোলস ছেড়ে বাইরে আসতে পারছে না। খুব অসহ্য লাগলো তার। টেবিলে মাথা রেখে চোখ বুজে বসে রইল বেশ কিছুক্ষণ। ভাবনা এলো মনে সবাই কি জেনে বুঝেই আমাকে এড়িয়ে চলছে? না কি আমিই পারছি না মিশতে ওদের সঙ্গে। অসহায় লাগছে নিজেকে বড়ো বেশি আজ। হঠাৎ কারো দুই হাত আমার দুটি হাত ধরে সজোরে চাপ দিতেই আমি আৎকে উঠলাম। সজোরে হাতটা ছাড়িয়ে মাথা তুলে সামনে তাকাতেই দেখি অর্নব হাসি মুখে টেবিলের অপর প্রান্তে বসে। সঙ্গে গোলাপ আমার প্রিয় চকলেট, কফি দুই কাপ, আর প্রিয় একটা হাতঘড়ি।শ্রী অবাক হয়ে হন্তদন্ত হয়ে তমার জন্য জায়গা ছেড়ে উঠতে যাচ্ছিল( হয়তো শ্রী ভুল জায়গায় এসে বসেছে ভেবে), অর্নব শ্রী হাত দুটি আবার নিজের হাতে চেপে ধরল। এই প্রথম আমি ওর আওয়াজ শুনলাম দীর্ঘ পাঁচ বছর পর। শ্রী কোথায় যাচ্ছো? তুমি ঠিক জায়গাতেই আছো,আমি ও ঠিক জায়গায়। কিছুই ভুল নেই।
আমি -কিন্তু তমা?
অর্নব- কষ্ট পাবে না, তমা আমার বন্ধু। আর তুমি আমার ভালোবাসা , আমার স্বপ্ন, আমার দুনিয়া, আমার সব, আমি আজও তোমাকেই ভালোবাসি।
আমি- কিন্তু পাঁচ বছর আগের সেই দিনটি? আমি যা চোখে দেখেছিলাম সে সব কি তবে মিথ্যে? আমার এতোদিনের কষ্ট ত্যাগ সব মিথ্যে?
অর্নব-তোমাকে ভুল বুঝিয়ে দুরে রেখে ছিলাম শ্রী, না হলে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারতাম না, তবে এটা ঠিক তমা ছিল বলেই এই অসাধ্য সাধন করতে পেরেছি।
মনে মনে শ্রী ভাবতে লাগলো হয়তো অর্নব ঠিকই বলছে আবার নাও বলতে পারে, কিন্তু তমার যে ভালোবাসা ওর জন্য দেখেছি চোখে মুখে সেটা একটা মেয়ে হয়ে এড়িয়ে যেতে পারিনা, সর্বোপরি ও আমার বন্ধু। শ্রী কে চুপ থাকতে দেখে অর্নব বললো-কি গো কিছু বলো চুপ করে কেন?
শ্রী-আমার সামনে সপ্তাহে বিয়ে অর্নব। শেষ পর্যন্ত সব ভেবে মা বাবার কথার অমত করতে পারি নি। আমি কষ্ট পাচ্ছি ঠিক আছে, তাই বলে ঐ মানুষ গুলোকে তো কষ্ট আর দিতে পরিনা। রাজি হয়ে গিয়েছি । আমি এখন আসছি, হবু বরের সঙ্গে পুজো দেখত বেরোতে হবে আজ। তমা ভীষণ ভালো ও খুব ভালো রাখবে তোকে, খুব ভালোও বাসে । ওকে আর কাঁদতে দিস না। আমি সেই প্রথম দিন আর আজও আসার পর থেকে তমা কে লক্ষ্য করে দেখেছি। ভিতরে ভিতরে ভাঙছে মেয়েটা। বলেই শ্রী উঠে দাঁড়ালো। এইবার আসি। দেরি হয়ে যাচ্ছে। ভালো থাকবি তোরা সবাই। তমার কাছে গিয়ে বললো- এতদিন অর্নবকে যে ভাবে ভালো রেখেছিস ঠিক তার থেকে আরও বেশি ভালো রাখিস তমা ওকে সারা জীবন । বলেই দ্রুত পা চালিয়ে বেরিয়ে এলো রাস্তায়। অর্নব নিস্পলক রাস্তার দিকে চেয়ে রইলো, ধীরে ধীরে রাস্তার লোকজনের মধ্যে শ্রী হারিয়ে গেল । অনেক দেরি হয়ে গেছে সব কিছুর। সব দেখে শ্রী নিজেকে আড়াল করে নিয়েছিল।
“কিছু গল্প থাকে মনের মাঝে খুব গোপনে,
পুড়তে থাকে মন,
মেঘলা আকাশ ঠিক লাগে না আর
রঙিন আলোয় ভালো থাকুক প্রিয়জন”
ঝুমা প্রামাণিক – কবি, সাহিত্যিক ও লেখক।