বৃষ্টি থেমেছে। পরিচ্ছন্ন আকাশে টুকরো টুকরো সাদা মেঘেরা দল বেঁধে ভেসে চলেছে নিরুদ্দেশে। নারিকেলের পাতায় ঠান্ডা বাতাসেরা দোলা দিয়ে যায়।বৃষ্টির ফোঁটায় কামিনী গাছের ফুটন্ত ফুলের ঝরে গেল পাপড়ি । সারা আঙিনা জুড়ে ছড়িয়ে আছে সেই সুগন্ধময় সাদা পাপড়ি। ইতিমধ্যে চৌধুরী সাহেব বারান্দায় চেয়ারটাতে এসে বসেছে সন্তর্পণে। ঠান্ডা বাতাস তার চোখে মুখে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিতে চায় বারবার। চৌধুরী সাহেব অনুভব করেন এক নান্দনিক পরিবেশের মধুরতা। তবে তার এসব কিছুই আর ভাল লাগে না। বুকের ভিতরে দড়াম দড়াম আছড়ে পরে কষ্টের করাঘাত। বেদনারা হৃদয়ের অন্তপুরে কেঁদে মরে বার বার। সারাক্ষন মনের মধ্যে একটি নাম লিখে যায়-বৃষ্টি। সব সময় বুকের ভিতরে উচ্চারিত হয়- বৃষ্টি আমার মা । আমার হৃদয়ের আঙিনা। আমার রক্তের ফল্গুধারা। বৃষ্টি শব্দটাই চৌধুরী সাহেবের ধ্যন জ্ঞান। যেন এই শব্দটার জন্যই তিনি বেঁচে আছেন।
চৌধুরী সাহেবের একমাত্র মেয়ে বৃষ্টি। সে বাবা মায়ের অমতে বিয়ে করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। বর্তমানে বাবা মায়ের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই।
চৌধুরী সাহেব একজন সৎ কর্তব্যপরায়ণ কর্মঠ ও হৃদয়বান মানুষ। অনেক বিড়ম্বনা আর কষ্ট থেকে নিজের যোগ্যতায় তিনি আজ সমাজের বিশিষ্ট একজন। বৃষ্টি তার প্রথম স্ত্রী শুভ্রার মেয়ে।শুভ্রার সাথে বিয়ের পর চৌধুরী সাহেবের জীবন ভরে উঠেছিল নতুন স্বপ্ন তোরণে। প্রীতিঘন সেই সময়ে জন্ম হয়েছিল বৃষ্টির। ছোট্ট সুন্দর পুতুলের মত মেয়েটাকে পেয়ে দু’জনের জীবন সুখ সম্মৃদ্ধিতে ভরে উঠেছিল। কিন্তু সে সুখ তার সহ্য হলোনা।
এক বৈশাখী দিনে শুভ্রা তার মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। বিকাল বেলা প্রচন্ড ঝড় উঠে। তছনছ করে দেয় সবকিছু। তার সাথে চৌধুরী সাহেবের জীবনও। সেই ঝড়ে ভেঙে যায় বহু ঘর-বাড়ি, গাছ-পালা, নষ্ট হয় রাস্তা-ঘাট, মারা যায় বহু মানুষ,ছিন্ন ভিন্ন হয় ক্ষেতের ফসল। সেই তান্ডবে শুভ্রাও মারা যায়। বেঁচে থাকে বৃষ্টি। চৌধুরী সাহেব তখন কর্মরত অন্য কোন জেলায়। শুভ্রাকে শেষবারের মত দেখতে পেলেন না তিনি। ছোট্ট বৃষ্টিকে চৌধুরী সাহেবের বড় বোন ফয়জুন্নেশা নিজের কাছে নিয়ে যান এবং তাকে আদর-যত্নে লালন- পালন করতে থাকেন।
শুভ্রার মৃত্যুতে ভেঙ্গে পড়েন চৌধুরী সাহেব। চরমভাবে তার স্বাস্থ্য অবনতি ঘটে। মানসিক ও শারীরিক ভাবে তিনি ভীষণ পর্যুদস্ত হয়ে পড়েন।
একে একে দিন পার হতে থাকে। কেটে যায় একটি বছর। সবাই মিলে চৌধুরী সাহেবের জন্য দ্বিতীয় বিয়ের ব্যবস্থা করে। প্রথমে একটু দ্বিমত থাকলেও বিয়ের পর চৌধুরী সাহেব দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে ভালই দিন কাটাচ্ছিলেন। এদিকে নতুন মায়ের কাছে সুখে -দুঃখে বড় হচ্ছে বৃষ্টি।
কিছু দিনের মধ্যেই বৃষ্টির পাশে এলো ছোট্ট ফুটফুটে ভাই। বৃষ্টি নিজের নামের সাথে মিলিয়ে নাম রাখলো মেঘ। ভাইকে পেয়ে সে খুব খুশি। ধীরে ধীরে বড় হয় মেঘ। হাঁটতে শেখে, কথা বলতে শেখে । বৃষ্টির আনন্দ আর ধরে না।সে তার ভাইকে খুব ভালোবাসে।
এক এক করে দিন চলে যায়। বড় হতে থাকে দু’ভাই বোন। হেসে খেলে একসাথে স্কুলে যায়। লেখাপড়া করে। দুটিতে খুব ভাব। এক সময় বৃষ্টি মাধ্যমিক শেষ করে কলেজে ভর্তি হয়। আর মেঘ নবম শ্রেনীতে। ছেলে -মেয়ের উত্তরণে আর দুজনের আন্তরীকতা দেখে চৌধুরী সাহেব খুব খুশী হন। তার ব্যবসায়ও বেশ উন্নতি হচ্ছে। সংসার সুখ স্বাচ্ছন্দে ভরা। বৃষ্টি একে একে এইচ এসসি, অনার্স, মাষ্টার্স কমপ্লিট করে। সে আপাতত একটি মাধ্যমিক স্কুলের চাকরীতে জয়েন করেছে। মেঘ অনার্স ফাষ্ট ইয়ারে। ইতিমধ্যে চৌধুরী সাহেব তার টিন সেট বাসা ভেঙে ছয়তলা বিশিষ্ট একটি বড় ভবন তৈরী করেন। এখন একটাই সাধ এবং কর্তব্য, মেয়েকে পাত্রস্থ করা। মেয়ের বিয়ে নিয়ে তার হাজার স্বপ্ন। তিনি চেয়েছিলেন তার মেয়ে একজন স্বনামধন্য ডাক্তার হবে। সারা দেশে তার নাম ছড়িয়ে পড়বে। সে গরীব দুঃখীদের বন্ধু হয়ে বিনামূল্যে চিকিৎসা দিবে। কিন্তু ডাক্তারি পড়তে রাজি হয়নি বৃষ্টি। যা হোক, এবার তাকে বিয়ে দেয়ার পালা।
চৌধুরী সাহেব ঘরে বসে একা একা ভাবেন, মেয়ের জন্য বিদেশ থেকে ডিগ্রি প্রাপ্ত ডাক্তার দেখব ? নাকি ব্রিলিয়ান্ট ইঞ্জিনিয়ার দেখব? বিজনেস ম্যাগনেট হলে কেমন হয়। কিংবা পুলিশ অফিসার? একা একা বিড়বিড় করছিল চৌধুরি সাহেব। এমন সময় তার স্ত্রী নার্গিস চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে ঢোকেন। বলেন, একা একা কি বিড়বিড় করছ ? চৌধুরী সাহেব হেসে বলেন, এসো নার্গিস বসো কথা বলি। মেয়েতো বড় হলো বিয়ে দিতে হবে না? সেজন্য আগে পরামর্শ করা দরকার।
একের পর এক বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করল। আসলে বৃষ্টিতো খুব সুন্দর ও শিক্ষিতা। রান্না-বান্না, ঘর-গৃহস্থালির কাজে সে বেশ নিপুণা। স্কুলের শিক্ষিকা। তাকে সবাই পছন্দ করে। অনেক ভাল ঘর বর তার জন্য এসেছে। কিন্তু এক এক করে সব সম্মন্ধই সে কোন না কোন অজুহাত দেখিয়ে বানচাল করে দেয়। এমন করে কেটে যায় আরো কিছু সময়। এর মধ্যেই চৌধুরী সাহেব জানতে পারেন তার মেয়ে নিজে তার বিয়ের ব্যবস্থা করে রেখেছে। এ কথা শোনার পর তিনি ভীষণ ভাবে আহত হন এবং অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। তার মেয়ে তাকে না জানিয়ে এভাবে নিজে নিজে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে এমনটি তিনি কোনদিনই ভাবতে পারেননি। খোঁজ নিয়ে দেখা যায় খুব সাধারন ঘরের সাধারন চাকরীজিবী এমন একটি ছেলেকে সে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে চায়। তিনি এ বিয়ে পছন্দ করতে পারেননি তাই এ ব্যপারে কোন আগ্রহও দেখাননি।
একদিন বৃষ্টি স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেনি। ওর টেবিলের উপর রেখে যাওয়া চিরকুট দেখে বুঝা যায় সে চলে গেছে তার নতুন জীবনের উদ্দেশ্যে। ঘটনা জানার পর ডুকরে কেঁদে উঠে ছোট ভাই মেঘ। চৌধুরী সাহেব ও তার স্ত্রী অশ্রুসিক্ত হন। চৌধুরী সাহেবের ভারাক্রান্ত হৃদয় যেন অভিমানে ফেটে পরে । তিনি দুঃখ করে বলেন, আজ তুই আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেলি। সুখে থাকিস মা,আমাকে ভুলে যাস। এ অধম বাবা আর তোর সুখী জীবনে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না। আর কোনদিন তোর খোঁজ করবে না।
বৃষ্টিও এক বুক অভিমান নিয়ে বাবাকে ছেড়ে একাই চলে যায়। তার ভাবনা, যাকে ভালবেসেছে তাকে ছাড়া সে সুখী হতে পারবে না। বাবা কেন এ সহজ কথাটি বুঝতে পারলেন না। কেন তাকে এভাবে একা চলে যেতে হলো।
বাবা মেয়ের তীব্র অভিমান বজায় থাকল দিনের পর দিন।
সময়ের ব্যবধানে বৃষ্টির কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে এক ছেলে । আত্মীয়-স্বজন অনেকেই হাসপাতালে বৃষ্টির পাশে দাড়ায়, সাহস জোগায়। কিন্তু চৌধুরী সাহেব নিরব অভিমানে শুধু চোখের জলই ফেলে যান। অসুস্থ্য মেয়েটাকে দেখতে যান না। দেখতে যান না সদ্য পৃথিবীতে আসা নাতিকে। হয়তো তিনি মনে মনে ভেবেছিলেন, মা তুই আমার কাছে একটিবার আয়। তোকে না দেখে আমি আর থাকতে পারছি না। তুই একবার এলে আমার সব অভিমান দূর হয়ে যাবে। মাগো তোর কি একবারও বাবাকে দেখতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় না বাবা তোর জন্য কষ্ট পেয়ে কত রোগা হয়ে গেছে।
বৃষ্টিও হয়তো এমনটি ভেবেছে। সে ভেবেছে আমার অসুস্থ্যতার কথা শুনেও বাবা একবার আমাকে দেখতে এলো না। কিন্তু কেও কারো অভিমান থেকে বা জিদ থেকে একপাও সরে না।
কেটে যায় কয়েকটি বছর। বাবা মেয়ের সম্পর্ক ছিন্ন মালার মত পড়ে রইলো। এদিকে কষ্ট চাপিয়ে রাখতে গিয়ে চৌধুরী সাহেব এক ভয়ংকর অসুখ বাঁধিয়ে ফেলেন। কারো কাছে নিজের মনের বা শরীরের কোন কষ্টের কথা ব্যক্ত করেন না তিনি।
তার বাড়ির সামনে এক টুকরো জায়গায় নানা রকম ফুল গাছে ভরা একটি বাগান আছে। চৌধুরী সাহেব মাঝে মধ্যে ওখানে পায়চারী করতেন। একদিন তার ছেলে মেঘ বাবাকে বাগানে পড়ে থকতে দেখে চিৎকার করে উঠে। সাথে সাথে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরীক্ষা- নিরীক্ষা করে ডাক্তার জানান, পেসেন্টের অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যল। তিনি আর বেশীদিন বাঁচবেন না। কথাটি বৃষ্টির কানে পৌছে। বৃষ্টি সজল চোখে ছেলেকে নিয়ে বাবাকে দেখতে এলো। চৌধুরী সাহেব ঘুমের ঘোরে ছিলেন। একটি শব্দ একটি ডাক তার কানে ভেসে এলো। বাবা—–।
হৃদয়ের দোয়ারে কে যেন নতুন করে কড়া নেড়ে গেল। চোখ তুলে তাকাতেই তিনি মেয়ের মুখটি দেখলেন। আর অভিমানের শত সহস্র জলকণা গড়িয়ে পড়ে দু’ চোখ বেয়ে। তিনি আবার কিছু না বলেই চোখ বন্ধ করে্ন। একটি ছোট্ট কোমল হাতের স্পর্শ পেলেন চৌধুরী সাহেব। ছোট্ট হাতটি তার চোখের জল মুছিয়ে দিল। বলল, “কেঁদো না নানু ভাইয়া!” তিনি চোখ তুলে তাকিইয়ে দেখলেন, এক ফুটফুটে ছোট্ট ছেলে। চৌধুরী সাহেব পরম আবেগে সেই ছোট্ট হাতটি নিজের হাতের মুঠিতে পুরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আর শুধু একটি কথাই বললেন, “নানু ভাই, আমি বাঁচতে চাই”।
দিল আফরোজ রিমা- কবি, লেখক ও সাহিত্যিক।