‘ টান দে বাজান, জোরে টান দে। জোয়ার তো আইসে পড়তিছে। জোয়ারের আগে চালনায় না যাতি পারলি বডড মুশকিলি পড়ে যাবানি।’-হাতের বৈঠায় টান দিয়ে ছেলে কালুকে উদ্দশ্য করে বলে ওঠে মনির মিয়া।
চলনা বাজারে জোয়ার শেষ হওয়া পর্যন্ত নৌকাসহ অবস্থান করবে পিতা-পুত্র। ওখান থেকে কিছু কেনাকাটাও শেষ করবে এই সময়ে। আবার ভাটির স্রোতে চলবে সুন্দরবন উপকূলের কালাবগী গ্রামের উদ্দেশ্যে। কালুও ঝপাৎ ঝপাৎ বৈঠা চালায়। বিশ বছরের তাগড়া যুবক। শরীরের কালো চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে আসে ঘাম। সকালের সোনালী রোদে চিকচিক করে ওঠে দুই বাহু, মাঝে মাঝে কপালে আঙুল টেনে ঘাম মুছে নেয় কালু।
বাপ ছেলে এবার বাদার সফরে বেরিয়েছে। কালাবগী গ্রামে মনির মিয়ার যুবক বয়সের বন্ধু হকের বাড়িতে প্রতিবার আশ্রয় নেয়। ওখানেই দু-চারদিন মাথা গুঁজলেও বেশিরভাগ সময়ই নৌকায়-নৌকায় থাকে। কালাবগীর পাশদিয়েই শিবসা নদী। শিবসা পার হলেই সুন্দরবন। সুন্দরবনের এখাল ওখালের মোহনায় বঁড়শি বেয়ে গলদা চিংড়ি ধরা মনিরের দীর্ঘদিনের নেশা ও পেশা। এতদিন অন্য কেউ এলেও এই দুবার হলো ছেলেকে নিয়ে এসেছে সে। অবশ্য মাঝের একটি বছর বিরতি দিয়েই এসেছে এবার।
‘ বাজান এবার কিন্তুক আমারে এট্টা মুবাইল কিনে দিতি অবেনে।’-বলেই সাদা দাত বেরিয়ে আনন্দে হেসে ওঠে কালু।
‘মাছ পাই কি না পাই, আগেই তোর মুবাইল! মাছ কি আর আগের মতোন আছে? হারামজাদারা মেটিসিন দিয়ে সব মাছ মাইরে শেষ করে দিচ্ছে।’-বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মনির।
একটি দীর্ঘশ্বাসেরর সাথে যেন বেরিয়ে আসে কত কথা। বঁড়শি বাওয়ার এই পেশায় কতো ঝঞ্ঝাটের কথা। খালের চরে চেয়ে থাকা বাঘের ভয় জয়ের কথা, মোহনায় মুখে হা করে থাকা কুমিরের ভয়ের কথা। সুন্দরবনে থাকা জলদস্যুদের সব লুট করে নিয়ে যাওয়ার কথা। তবুও হাতে বৈঠা নিয়ে বেয়ে যেতে হয়। এগিয়ে যেতে হয় আশা নিয়ে। নিজেদের কি এমন জমি আছে! যা চাষ করে খায়?
কালাবগী গ্রামে এসে বন্ধু হকের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। অনেকদিন বাদে বন্ধুকে পেয়ে হকও খুশি। রাতটুকু কাটিয়ে কিছু মালামাল রেখে সকালেই ছেলেকে নিয়ে বনে ছুটবে মনির মিয়া। দুজনের শুরু হয় পুরনো স্মৃতিচারণ। কত গল্প, সেই হা ডু ডু খেলার কথা, বাজি ধরে চারফানা কলা খাওয়ার কথা। ওপাশে গোলপাতা ছাউনির নিচে রান্নাঘর। ওখান থেকেই শব্দ আসে ঘুটঘাট রান্নার। গরম তেলের উপর মশলা ছাড়ার ঝাঁঝালো একটা ঘ্রাণ এসে নাকে লাগে কালুর। সারাদিন বৈঠা টানার খাটুনি শেষে পেটটাও কেমন ক্ষুধায় মোচড় দিয়ে ওঠে।
চাঁদনি রাতের আলোয় খেজুরের পাটি বিছিয়ে গল্প করছিলো হক ও মনির। পাশেই কাত হয়ে ঝিমাচ্ছিলো কালু। হঠাৎ বড় ঘরটি থেকে আওয়াজ ভেসে আসে, ‘ মুন্নির বাপ, ও ঘরে মান্দুর দিছি খাতি আসো তুমরা।’
কথার মাঝে ছেদ পড়ে। কালুকে নিয়ে খেতে যায় মনির ও হক।
সেই যুবক বয়সের খাওয়ার অংকটি যেন হারিয়ে ফেলেছে মনির। ক্ষুধার্ত পেটে খেয়ে চলছিলো কালু। এক বাটি খরুল্লা মাছের ভূনা এনে হাজির হলো মুন্নি। বাবার দিক চামুচটি এগোতেই না না করে উঠলো। কালু হা-না কি বলবে ভেবে উঠতে পারলো না। হারিকেনের আলোর পাশে এই শ্যামলাবরণ মেয়েটির মুখ যেন জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠলো। আচমকা বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো কালুর। কালু কি তিন বছর আগের সেই মুন্নিকে দেখছে!
সকালে শিবসা পার হয়ে একটি খাল বেয়ে বনের গভীরে ঢুকলো নৌকা। সারাদিন বঁড়শি বেয়ে গলদা চিংড়ি ধরে নৌকার মাঝে অল্প পানিতে জিইয়ে রাখে। ছোট একটি মাটির চুলায় ভাত রাধে কালু। ভাতের মাঝে আলু সিদ্ধ করে নেয়। মরিচ, পেঁয়াজ, সরিষার তেল দিয়ে ভর্তা বানিয়ে খাওয়া শেষ করে বাপ-বেটা। কয়েকদিনের জমানো মাছ কালাবগী গ্রামের হরেনের মাছের আড়তে বিক্রি করে যায়।
বঁড়শি বেয়ে চলা নিরব সময়টা এবার যেন কালুর অন্যরকম হয়ে উঠেছে। চিংড়ি মাছে সুতা টেনে নিয়ে যায়, তবু ছিপ টান দিতে খেয়াল থাকে না তার। জলের উপর যেন মুন্নির মুখচ্ছবি এসে কথা বলতে শুরু করে। কালো চুল আর উর্বর মুখের সাথে কথা বলতে বলতে হেসে ফেলে কালু।
‘চলো বাজান, আজ ডাঙায় উঠি। গলাডা খুশখুশ করতিছে, চা-টা খায়ে আসিগে। মাছ কডাও বেচে আসি’-বলে ওঠে কালু।
কিছুই আচ করতে পারে না মনির। তবে এই কয়েকদিনে এটা ঠিক বুঝতে পেরেছে ছেলেটা ইদানীং খুব অন্যমনস্ক।
মাছ বিক্রি শেষ। দোকানে এককাপ চা মুখে দিয়ে দ্রুত ফিরে আসে কালু। বিকেলে অল্প আলোয় মুন্নিদের বাড়ি ঢুকতেই চোখাচোখি হয় দুজনের। হয়তো কালুর চাহনির ভাষা বুঝে নিয়েছে মুন্নি। গেলোবারও দুজনের অনেক কথা হয়েছে কিন্তু এবার দুজনের মাঝে কি এক লুকোচুরি, কি এক লজ্জা এসে বাধা হয়ে উঠছে। তবে কি হক ও মনিরের বন্ধুত্ব রক্ষায় ছেলে-মেয়ের বিয়ে ঠিকঠাকের অনেকটা পাকাপাকি কথা মুন্নি ও কালু জেনেছে! রাতে আকাশের চাঁদ দেখে কালু। চাঁদের আলো বুঝি আজ খুব আলো ছড়াচ্ছে? অনেকটা রাত নির্ঘুম কেটে যায় কালুর।
পরদিন ওড়া গাছটির নিচে হঠাতই যেন অপ্রস্তুত এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যেন রণাঙ্গনের শেষ প্রতিচ্ছবি। দুই যোদ্ধার সংগীন যুদ্ধ। এক যোদ্ধার মুখে সূচালু আটটি বড়ো দাত আর কালুর হাতে মধুর চাক কাটা একখানা ধারালো গাছি দা। বৈঠা হাতে বাঘের গায়ে আঘাত করছে বাবা মনির। বাম বাহুতে কামড় বসিয়েছে বাঘটি। ডান হাতের দা দিয়ে কয়েকটি কোপ বসিয়ে দিলো কালু। রক্তাত্ব কালু, রক্তাক্ত বাঘটিও। এক সময় ছেড়ে পালালো বাঘটি। আজ কালুর হঠাৎ সিদ্ধান্তে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেক ভুল করে ফেলেছে বাবা-ছেলে।
প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। নদীর তীরে ছুটে এসেছে বহু মানুষ। মনিরের সাথে নৌকার বৈঠা হাতে নিয়েছে মুন্নির বাবা। এখন ভাটা নামছে। হয়তো হাতে বেশি সময় নেই। আজ উজান বেয়েই যেতে হবে চালনায়। ওখানেই হাসপাতাল। নৌকার পাশে মায়ের পাশ থেকে তাকিয়ে আছে মুন্নি। চোখবোঁজা কালুকে আজ সে দেখছে প্রাণভরে। এরই মধ্যে সবার চোখ ফাঁকি দেয় মুন্নি। সবার অজান্তেই মুছে নেয় নিজের দুটি ভেঁজা চোখ।
তারিকুল ইসলাম সুমন- কবি ও সাহিত্যিক