তোর বাবা সোহেল আহমেদ ছিলেন একজন সৈনিক। আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি; তখন তার সাথে আমার বিয়ে হয়। বিয়ের সময় আমার বয়স ছিলো মাত্র ষোল বছর, আর তোর বাবার বয়স চব্বিশ বছর। বিয়ে হবার পর আমি এস এস সি পরিক্ষা দেই। উনি ছিলেন যশোহর ক্যান্টনমেন্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। আমার পরীক্ষার পর উনি আমাকে নিয়ে আসেন যশোহর ক্যান্টনমেন্ট সরকারি কোয়ার্টারে। আমরা দুজন ভালোই ছিলাম কী সুন্দর করে তোর বাবা সকালে সেনাবাহিনীর ড্রেস পরে চলে যেত আর আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম। দুপুরে বাসায় ফিরে আসতো, আবার বিকেলে চলে যেত। এভাবেই চলছিলো আমাদের বিবাহিত জীবন। স্বপ্নের মতন আমরা দুজন দুজনকে নিয়ে সারাদিন পার করতাম। হঠাৎ একদিন আমি মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। উনি আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তার দেখেনো শেষে ওনার সে কি আনন্দ। আমাকে জাপটে ধরে বললো আমাদের সন্তান স্বাধীন দেশে জন্ম গ্রহণ করবে। পরাধীনতার শেকল ভেঙ্গে আমরা দেশ স্বাধীন করবো। আর তখনই আমার সন্তান ভুমিষ্ঠ হবে।
আমি একটু একটু করে অসুস্থ হয়ে পড়লাম; খেতে পারছিনা সব সময় বমি বমি ভাব, মাথা ঘুরায়। আমার বয়স কম তারপর মা হতে চলেছি। তাই তোর বাবা আমাকে কোন কাজই করতে দেয় না। আমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দেওয়া, রান্না করা সব করছে। ছোটবেলা থেকেই তোর বাবা সব কাজ করতে পারতো কারণ তোর বাবার, বাবা মা কেউ ছিলো না, মামা বাড়িতে মানুয হয়েছিলো তাই সবই করতে পারতো অনায়াসে। দেখতে দেখতে আমি তিন মাসের গর্ভবতী হলাম। আর শুরু হলো চারিদিকে দেশ স্বাধীন করার মিছিল মিটিং। তোর বাবাকে সব সময় চিন্তিত দেখাতো। আমি মনে মনে খুব ভয় পেতাম। গভীর রাত পর্যন্ত বাসায় আসতো না। আমি সব সময় আতংকে থাকতাম কি যেন হয়!
একদিন গভীর রাতে তোর বাবা এসে বললো ,রেবা, তাড়াতাড়ি তৈরি হও আমি তোমাকে তোমার বাপের বাড়িতে রেখে আসি। যে কোন মুহূর্তে আমাকে যুদ্ধে যেতে হবে। আর এক মুহূর্তও এখানে থাকা যাবেনা। আমি সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয়ে নিলাম; দুজন বেরিয়ে পড়লাম। গভীররাত কখনও বাসে কখনও হেঁটে হেঁটে আমরা এসে পৌঁছালাম নড়াইল চিত্রা নদীর পাড়ে।
তখন ভোর হয়ে আসছে তোর বাবা আমাকে বললো, আমি তোমাকে নদী পার করে দিতে পারবো না আমাকে খুব শিগগির চলে যেতে হবে। আমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। তোর বাবা আমার হাত ধরে বললো চিত্রা নদী সাক্ষী রইলো আমি দেশ স্বাধীন করে তারপর তোমার কাছে ফিরে আসবো। যদি আমাদের মেয়ে হয় নাম রাখবে চিত্রা আর যদি ছেলে হয় নাম রাখবে স্বাধীন। আমি নৌকায় উঠে বসলাম যতদুর দেখা যায় তোর বাবা দাঁড়িয়েছিলো। আর আমি নদীর জলের সাথে আমার কান্নার জল ভাসিয়ে দিলাম। দেখতেই পারছিস চিত্রা নদী পার হলেই তোর নানা বাড়ি। বিয়ের পর তোর বাবা ছুটিতে বাড়ি এলেই আমরা নৌকায় চিত্রা নদীর পাড়ে ঘুরতে আসতাম। এবং চিত্রা নদীর পাড়ে বসে তোর বাবার হাতে হাত রেখে গল্প করতাম। এসবই এখন শুধুই স্মৃতি।
এক মাস পর তোর বাবার একখানা চিঠি পেলাম। চিঠিতে লিখেছে আমি যুদ্ধে গেলাম অনেক গুলো অপারেশন আছে সব ঠিকঠাক করতে হবে। নইলে পাক হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে আমরা এবং আমাদের মা বোনেরা রেহাই পাবে না। দোওয়া করো আমার জন্য। চিঠিখানা পড়তে পড়তে আমি কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম। এর মাঝে কতদিন পেরিয়ে গেল তার কোন খবর নেই। সারাদেশ উত্তাল চারিদিকে যুদ্ধ আর যুদ্ধ,হত্যা,লুন্ঠন, মা বোনদের ইজ্জত নিয়ে কাড়াকাড়ি। এত সবের মধ্যে তুই আমার পেটের মধ্যে একটু একটু করে বড় হচ্ছিস। আমি সব সময় পথপানে চেয়ে থাকতাম এই বুঝি তোর বাবা এলো। কত রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি তার অপেক্ষায়। আস্তে আস্তে করে দেশ স্বাধীন হতে শুরু করলো। কিন্তু তোর বাবার কোন খবর নাই। সত্যি একদিন দেশ স্বাধীন হলো। স্বাধীন দেশে তোর জন্ম হলো। তোর নাম রাখলাম স্বাধীন।
বিশাল একখানা লাল সবুজের পতাকার জন্ম হলো। আমি অপেক্ষায় থাকলাম তোর বাবা ফিরবে। এক বছর পর জানতে পারলাম যশোহর থেকে চুয়াডাঙ্গার পথে একটা ব্রিজ উড়িয়ে দেবার সময় তোর বাবা সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হয়েছে। তারপর থেকে আমার আর কোন অপেক্ষা নেই। সত্যি চিত্রা নদী আর তুই আমার জীবনে স্বাধীনতার স্বাক্ষর হয়ে আছিস। স্বাধীনতার জন্যে দেশের জন্যে তোর বাবা শহীদ হয়েছে। ত্রিশলক্ষ বাঙালির রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি।
কতো ঝড়ঝাপটা আমার উপর দিয়ে গেছে। খেয়ে না খেয়ে মানুষের অবজ্ঞা অবহেলায় তোমার ছেলেকে বুকে নিয়ে দিনযাপন করেছি। তবুও স্বাধীনকে আমি হাত ছাড়া করিনি, মানুষ করেছি। তুমি যুদ্ধ করে শহীদ হয়ে জীবন উৎসর্গ করেছো। আর আমি বেঁচে থেকে জীবনযুদ্ধ করেছি। এভাবেই তোমাকে ছাড়া আমি একা একা কত শীত,বসন্ত,বর্ষা যৌবনের রঙিনদিন গুলো কাটিয়ে দিলাম। আজ একান্ন বছর পর স্বাধীনতা দিবসে তোমার ছেলের হাত ধরে চিত্রা নদীর পাড়ে বসে তোমার গল্পটা বললাম। আর এখানেই আমরা মা ছেলে দুজন ফুল দিয়ে তোমাকে ও সকল শহীদদের জন্য শ্রদ্ধা নিবেদন করলাম। আর মনে মনে বললাম….
আমার মাঝে আছো হে তুমি
জড়ায়ে তোমারে বঙ্গভুমি
সবুজের ঘাসে নীলের আকাশে
তোমারই সুরে জুড়াইতে চাই
যে দেহপ্রাণে আছো গো ধরা
সুখেরই মাঝে দুখেতে ভরা
লোহিত সোপানে ত্যাগেরই আসনে
অস্রুজলে গো ভাসিতে চাই —–
ইসরাত জাহান – গল্পকার ও সাহিত্যিক।