লোকটা পানের পিক নদীর পানিতে ফেললো।রিনি জড়সড় হয়ে বসে আছে নৌকার ছৈয়ের ভেতরে ।নৌকাটা বেশ বড় হলেও লোকটা রিনির পাশেই বসেছে।মুখের পান শেষ না করেই নতুন একটা পান বানাচ্ছে। চুন,সুপারি খুব যত্ন করে লাগিয়ে রিনির দিকে
বাড়িয়ে দিয়ে বললো,” খাও একটা পান খাও।”
রিনির ইচ্ছে করছে লোকটাকে কষে একটা থাপ্পড় মারতে ।কিন্তু মানুষের যা ইচ্ছে করে তা করতে পারে না জীবনের অধিকাংশ সময়। মেয়েরা তো আরও পারে না।আর সেই মেয়ে যদি হয় রিনির মত তাহলে তো কোন কথাই নেই।
রিনি ছোট করে বললো,” পান খাবো না।”
লোকটা তারপরও পান হাতে বসে আছে।প্রতি কথায় সে একবার করে পানের পিক নদীর পানিতে ফেলছে।দৃশ্য টা কতটা কুৎসিত লোকটা কি বুঝতে পারছে না?
লোকটা হাত নেড়েনেড়ে বলছে, ” দুনিয়া বড় আজব
জায়গা বুজেছ রিনি বেগম। গেলাম তোমার বিয়ে
খেতে। আর এখন তোমারেই বিয়া করে সাথে নিয়ে
যাচ্ছি বউ করে।কি আজিব একটা দুনিয়া।তুমি কি
আমার নাম জানো? ”
রিনি মনে মনে বললো,” না জানি না।জানতে চাইছি না।”
লোকটা আবার বলল,”তোমার যদি কথা বলতে লজ্জা
লাগে তবে মাথা নেড়ে উত্তর দিবা।ইয়েস, নো এর মত।
প্রথম প্রথম তোমার সমস্যা হবে এটা আমিও জানি।
তুমি হয়তো আমার সম্পর্কে তেমন কিছু জানো না।
সামির সম্পর্কে জানা থাকা ভালো।একজন মানুষের
সাথে সংসার করবা তারে না চিনলেও চলবে তবে তারে
জানা টা দরকার। না হলে সংসার করবা কি করে?
আমি যে একেবারে লেখাপড়া জানি না তা না।আমি
বি.এ পর্যন্ত পড়েছিলাম।এম.এ ভর্তি হতে চেয়েছিলাম
কিন্তু ব্যবসায় এমন ভাবে ব্যস্ত হয়ে গেলাম লেখাপড়া
টা হলো না আর। তবে তুমি শিক্ষিত মেয়ে।অনার্স পাশ।
তুমি এম.এ করবা সামনে। তুমি যদি চাও আমি নিজেও
এম.এ করে ফেলবো।পোলাপান জানবো তাদের বাপ
বি.এ. পাশ। মা এম.এ. ভালো দেখায় না কি বলো? ”
রিনির মাথা ধরে গেছে এই লোকের কথার অত্যাচারে। সে বিয়ের ভারি শাড়ি, গহনা পরে না থাকলে এতোক্ষনে নৌকার একপাশে শুয়ে ঘুমিয়ে যেতো। সামনে যে লোক কথা বলছে সে মাত্র ২ ঘন্টা আগে রিনির সামি হিসেবে কাবিননামায় সই করেছে।না সে একা করে নাই।রিনিও নিজের হাতে সই করেছে।তখন কাগজের লেখা দেখেছে লোকটার নাম কালাম।এটুকুই জানে রিনি লোকটার সম্পর্কে।লোকটা খুব বেশি লম্বা না।কত হবে? পাঁচ ফুট পাঁচ বা ছয়।রিনি লম্বায় পাচঁ ফুট তিন।রিনির চেয়ে খুব লম্বা না।গায়ের রং হয়তো এক সময় ফর্সাই ছিলো।কিন্তু রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে।লোকটার মাথা ভর্তিচুল। প্রথমেই যে কারও চোখ লোকটার চুলের ওপর পড়বে।কিন্তু কথাবার্তায় একেবারে গেঁয়ো ধরনের।এমন একজন লোক রিনির সামি??
গতকাল রাতেও রিনি জানতো তার বিয়ে হচ্ছে শিহাবের সাথে।শিহাবের সাথে রিনির ৩ বছরের প্রেম।শিহাব লম্বা ৫ফুট ৮/৯। খুব ফর্সা, স্মার্ট এক সুদর্শন ছেলে।ওর পরিবারও ভালো।সব ঠিক মত এগুচ্ছিলো।রিনি আজ যে বিয়ের শাড়ি পরে আছে সেই শাড়িটাও শিহাব আর ও পছন্দ করে কিনেছে। কত স্বপ্ন । কত পরিকল্পনা। সব কিছু শেষ হয়ে গেলো।রিনির কান্না করা উচিৎ খুব কিন্তু একটুও চোখে পানি আসছে না।খুব মাথা ঘুরছে।ঘুম পাচ্ছে।
কালাম মাঝিকে গলা উঁচিয়ে ডাকলো,” ও মাঝি ভাই।
পান খাবেন নাকি? ভালো পান খেয়ে দেখেন একটা।”
মাঝি পান পেয়ে বেশ খুশি খুশি গলায় বললো,
“ভাইজান বিয়া কি একাই করে আনলেন?”
কামাল হাসি দিয়ে বললো, “সে এক বিরাট ইতিহাস।
একদিন সময় করে বাসায় আসেন গল্প শুনে যাবেন
গরীবের বাসায় দাওয়াতও খাবেন।বকুলপুর গায়ের
মির্জা বাড়ি আমার দাদার। আগে বড় লোক ছিলেন
তারা।মাঝে বাপ চাচা সব বিক্রি করে দিয়েছে।আমি সে
সব আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি।দোয়া
রাইখেন।আপনার ভাবির জন্য দোয়া রাইখেন।”
রিনি অবাক হয়ে এই মানুষটাকে দেখছে।তার বিয়ে ভেঙে যাবার পর এই লোকটার সাথে যখন বিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত হলো।কেউ রিনির মতামত জিজ্ঞেস করেনি।রিনি ধরেই নিয়েছিলো একজন গ্রাম্য অশিক্ষিত দারিদ্র কারও সাথে তার বিয়ে হচ্ছে।কিন্তু এখন তো তা মনে হচ্ছে রিনির সব ধারনা সঠিক না।
কালাম বাড়িতে ঢুকে খুব লজ্জিত ভাবে বললো,
“বাড়িতে কেউ নাই তোমারে বরন করে নিবে এমন।
তুমি ঘরে গিয়া বস। আমার দাদি তার মেয়ের বাড়ি
গিয়েছেন।আমি এখনি তাকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা
করছি।দাদি এলে তিনিই সব ব্যবস্থা করবেন।আমি তো
নিয়ম কানুন কিছু জানি না।”
রিনি একাই কালামের দেখিয়ে দেওয়া ঘরে ঢুকলো।এই ঘর এখন তার?? এই খাটে তাকে ঘুমাতে হবে? এই বাড়ি তার শশুড় বাড়ি?? এমন তো হবার কথা ছিলো না।
সব ঠিক মত হচ্ছিলো।বিয়ের আয়োজন।বিয়ের বাজার।দুই জনার প্রেমের মাঝেও কোন ফাঁকিবাজি ছিলো না বিয়ের আসরে বসার আগে পর্যন্ত রিনি নিশ্চিত ছিলো। বিয়ের আসরে কেউ একজন যখন বর পক্ষের লোকদের জানায় খুব ছোটবেলায় রিনির এক কালো অধ্যায়ের কথা। বর পক্ষের লোকজন খুব হৈচৈ শুরু করল।তারা কিছুতেই বিয়ে এখানে দেবে না তাদের ছেলের।অথচ শিহাব সব কিছু জানতো।সে বলেছিলো তার পরিবারকে সে সব বলেছে।কিন্তু পরে বোঝা গেলো না সে তার পরিবারকে কিছুই জানায়নি।এমনকি রিনিকে অবাক করে দিয়ে শিহাব বিয়ের আসর থেকে উঠে গেলো।রিনির পরিবার চিন্তাও করতে পারে নাই এমন কিছু হতে পারে বিয়ের আসরে।কয়েকশ লোক বিয়ের দাওয়াত খেতে এসেছে।এদের মাঝে বাবাকে ছোট করতে পারে নাই রিনি।
ছোট চাচা যখন বললেন, আজই আমরা রিনির বিয়ে
দেবো। ছেলে আমি নিয়ো আসবো।”
তারপরের ঘটনা খুব দ্রুত ঘটলো।একটু পর রিনি আবিষ্কার করল ওর পাশে এমন একজন লোককে বর হিসেবে বসানো হলো যাকে রিনি কোনদিন দেখে নাই।বিয়ে করবে না এ কথাটুকু বলার মত অবস্থা রিনির ছিলো না তখন ।রিনির নিজের মা থাকলে হয়তো বাধা দিতো।কেউ একজন হয়তো রিনিকে জড়িয়ে ধরে শান্তনা দিতো।কিন্তু একটা শান্তনার কন্ঠ, একটু স্নেহের পরশ দিয়েও কেউ রিনির মাথায় হাত রাখলো না।সবাই পরিবারের, বংশের সম্মান নিয়ে উৎকন্ঠায় ব্যস্ত। কিন্তু রিনির কি দোষ? কেনো ছোটবেলার এক ভয়ংকর লোকের কালো থাবা রিনির সারা জিবনের সমস্ত আলোকে ঢেকে দেবে? কেনো রিনিকে বয়ে বেড়াতে হবে সেই দুঃসহ সন্ধ্যার স্মৃতি।
সে দিন কত তারিখ ছিলো রিনির মনে নেই।কি বার ছিলো? কি মাস ছিলো কিছুই মনে নেই রিনির।
শুধু সেই লোকটার চেহারা মনে আছে। লোকটা ছিলো রিনির শিক্ষক।রিনিকে বাসায় এসে পড়াতো সন্ধ্যার পর। ওর বয়স তখন ১১কি ১২। রিনির মা মারা গিয়ে ছিলেন রিনির যখন ৩ বছর বয়স তখন।রিনির নতুন মা প্রায়ই ওকে কাজের মেয়ের কাছে রেখে এখানে ওখানে বেড়াতে যেতেন।তখনও রিনির নতুন ভাই বোন হয় নাই। বাবা বাসায় ফিরতো রাত ১০/১১টার পর।অন্য দিনের মত সে দিনও বাড়িতে বাবা মা ছিলো না।কাজের মহিলা ছিলো একজন। সেও বাড়ির ওপর পাশের রান্না ঘরে রান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকতো সন্ধ্যায়।
রিনি পড়ছিলো।হঠাৎ তার শিক্ষিত বাবা মায়ের কাছে ভালো ছেলে খেতাব পাওয়া শিক্ষক দরজা আটকিয়ে দেয়।প্রথমে রিনি চমকে গিয়েছিলো।তারপর..তারপর..।
রিনির কিছুই মনে পড়ে না।যখন জ্ঞান ফিরে এলো হাসপাতালে নিজেকে আবিষ্কার করেছিলো। পুলিশ এলো, কত কিছু।ছোট করে পত্রিকায় খবরও যায়। ১১ বছরের মেয়েকে গৃহশিক্ষক কর্তৃক ধর্ষনের খবর কত কিছু রং চড়িয়ে লেখা হয়।
এখন রিনির বাবা আফসোস করেন।সেই সময় ঘটনাটা চেপে গেলে হয়তো তার মেয়ের জীবনটা আর একটু মসৃন হতো।কিন্তু রিনি জানে সে দিন যদি এর প্রতিবাদ করা না হতো।তাহলে আরও কতশত রিনির জীবন সেই শিক্ষক নামের নরপশু নষ্ট করতো কে জানে।এক রিনির চলার পথ না হয় কিছুটা কঠিন হয়েছে ঐ নরপশুকে আইনের আওতায় আনতে। কিন্তু তার শাস্তি তো হয়েছে।জীবনে চলার পথে সত্যিকারের মানুষ তো চিনতে পারছে রিনি।
রিনি ঘুমিয়ে গিয়েছিলো বিয়ের পোশাকেই।হঠাৎ কপালে কার হাতের স্পর্শে চমকে উঠে রিনি।ভয়ে চিৎকার করে বসতো হয়তো।কিন্তু পরক্ষনে মোমবাতির আলোয় কালামের হাসি মুখ দেখে তাড়াতাড়ি উঠে বসে।
কালাম হেসে বলে,” তোমারে বসায় রেখে বাজারে
গেলাম কিছু খাবার দাবারের ব্যবস্থা তো করা দরকার।
এই গ্রামে আমার একটা সম্মান আছে বুঝলা রিনি
বেগম।বাহিরে যেয়ে দেখো নতুন বউ দেখতে পুরো
গ্রামের বউ ঝি চলে এসেছে। তুৃমি ঘুমাচ্ছ তাই
ডাকাডাকি করতে না করছি। গান শুনতে পাচ্ছ ?
খুশিতে গান বাজনাও করছে চাচিরা।নতুন বউ দেখতে
সবাই এসেছে। তাদের তো বউ দেখিয়ে না খাইয়ে যেতে
দিতে পারি না।আজ ছোট আয়োজন হোক।কাল বড়
করে খাওয়াবো কি বলো?”
রিনি অবাক হয়ে শুনছে সত্যি কারা যেনো খুব সুর করে গান করছে ।রিনি জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালো।বাহিরে রাত হয়ে গেছে।উঠানে হ্যাজাক বাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।মহিলারা পাটি পেতে বসে গল্প করছে।কেউ কেউ গান করছে।বাচ্চারা দৌড়াদৌড়ি করছে।একপাশে গাছের নিচে বড় ডেকচিতে রান্না হচ্ছে। সেখানে ছেলেদের বেশ ভীড়।
রিনি অবাক হয়ে বললো, “এতো আয়োজন কেনো?”
কালাম মাথা নিচু করে হেসে বললো, “তুমি আমারে
যতটা দরিদ্র মনে করছ আমি ততটা না।আল্লাহ কিছু
টাকা পয়সা দিয়েছেন।তোমার স্বামী মাশাল্লাহ পরিশ্রম
করে।বিয়ে তো বার বার করবো না।একটু আনন্দ
আহ্লাদ করতে চায় আমার দাদি।তুমি ঘুমিয়ে ছিলা
আমার দাদি তোমারে দেখে গেছে।তার খুব পছন্দ
হয়েছে তোমারে।দাদির সখ একটু হৈচৈ হোক।”
কালামকে থামিয়ে দিয়ে রিনি বললো,” আপনার দাদি
আমার অতীতটা জানলে এই আনন্দ করতে দিতেন
না।”
কালাম বললো, “দাদিকে আমি বড় ভালোবাসি রিনি
বেগম। আমার বাবা মা অনেক ছোটবেলায় মারা
গিয়েছেন।দাদিই আমাকে বড় করেছেন। দাদি নারাজ
হবে এমন কাজ আমি করি নাই কখনও।করবো না।
তোমার কথা দাদিকে সব বলেছি আমি।দাদি অনেক
খুশি হয়েছে। দাদি আমার জন্য অন্তর থেকে দোয়া
করেছেন।তোমারে একটা কথা বলি শোন।তোমার
সাথে যা হইছে এটা কিছু মনে করবা না।কত কিছুই
তো জীবনে ঘটে।সবকিছু গুরুত্ত দিবা না। আমার দাদি
ছিলেন ১৯৭১ সালের বিরাঙ্গনা। যুদ্ধের সময় দাদিকে
পাক বাহিনী আটকে রেখেছিল। যুদ্ধের পর আমার
দাদা যুদ্ধ থেকে ফিরে কারও কথা শুনে নাই।দাদিকে
নিয়ে সংসার করছে।এতো বছর পর আমি বুঝি দাদা
কোন ভুল কাজ করেন নাই।আমি আজ যা করেছি
এটাও ভুল না।আল্লাহ চেয়েছেন এভাবে তোমার সাথে
আমার পরিচয় হোক তাই এভাবেই হয়েছে।তোমাকে
আমি খুশি রাখার চেষ্টা করবো এটুকু বলতে পারি রিনি
বেগম।”
রিনি অবাক হয়ে কালাম নামের এই লোকটির কথা
শুনছিলো।হঠাৎ বাহিরে থেকে কেউ একজন
ডাকলো,”ও কালাম বইয়ের লগে কি তুই একাই গল্প
করবি না কি আমাদের ও একটু গল্প করতে দিবি।সেই
যে বউ ঘরে ঢুকছে বাহিরও হয় না।নাত বৌকে বাহিরে
আসতে বল।দেখি চাঁদ না কি তোর বউ কে বেশি
সুন্দর।”
মহিলাদের মধ্য বেশ হাসির হিড়িক পরে গেলো।
কালাম লজ্জা পেয়ে বললো, একটু বাহিরে গিয়া দাদির
পাশে বস।খুশি হইবো খুব।”
রিনির মন থেকে বিশাল এক পাথর সরে গিয়েছে।
শিহাবের মত অতি আধুনিক পরিবেশে বড় হয়েও
মানসিকতায় কালামের মত সাধারণ পরিবারের ছেলের
কাছে হেরে গেলো।
রিনি কি মনে করে হাতের চুড়ি, গলার মালা সব খুলে
ফেললো।কালামের দিকে তাকিয়ে বললো, “আপনার
কাছে বউকে বিয়ের শাড়ি কিনে দেবার মত টাকা কি আছে?”
কালাম অবাক হয়ে বললো, “কি বলো থাকবে না কেনো?”
রিনি হেসে বললে, “তাহলে এখন যান। বিয়ের শাড়ি
গহনা কিনে আনেন।অন্যর দেওয়া শাড়ি পরে আমি
আপনার দাদির সামনে যাবো না। আমি কালামের বউ
হয়েই তার কাছে যাবো।আর একটা কথা আজ থেকে
আপনার পান খাওয়া বন্ধ। নয়তো আমি এমন পান
খাওয়া শুরু করবো, তখন বুঝবেন। এখন যান।
তাড়াতাড়ি আসবেন।আমি অপেক্ষা করছি।”
সেলিনা রহমান শেলী- কবিও সাহিত্যিক।