আজ আমার বাবার বিয়ে। বিয়েটা আমি নিজেই অভিভাবক হয়ে বাবাকে করাচ্ছি। খরচ বরচ সব আমার। আয়োজনও আমি নিজের হাতেই করছি।
বাবার জন্য অনলাইনে অর্ডার করে একটা ক্রিম কালারের পাঞ্জাবি আনিয়েছি সাথে পাজামাও আছে। পাঞ্জাবিটা ভীষণ সুন্দর। বাবার খুব পছন্দ হয়েছে।
আজ অাষাঢ় মাসের ১ তারিখ শুক্রবার। বাবার বিয়ের জন্য আমি এই দিনটাই ঠিক করেছি। কারণ আজ বাবার বিবাহবার্ষিকী। সবাই বৃষ্টি হবে ভেবে দুশ্চিন্তা করছে। আমার কেমন যেন মজা হচ্ছে। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বরযাত্রী যাবে। আবার বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে কনে নিয়ে হাজির হবে। অনেক বেশি কষ্ট হবে, লণ্ডভণ্ড হবে সব আয়োজন। আপ্যায়িত অতিথিদের ভোগান্তির শেষ থাকবে না।
তারপরও দারুণ একটা মজা হবে ফুলশয্যার ঘরে। আকাশ ভেঙে বৃষ্টির ধারা বইবে বাইরে। অাকাশের জমানো কষ্টের মেঘ বৃষ্টি হয়ে ভূপতিত হবে। আর ফুলে ফুলে সাজানো ফুলশয্যার ঘরে দুজন দুঃখী মানুষ পড়ন্ত বেলায় এসে নিজেদের হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলো আবার জোড়া লাগাবে।
আমি বাবাকে বিয়ে করালেও আমার মা কিন্তু এখনো জীবিত আছেন। তিনি সুস্থও আছেন।
মাকে রেখে বাবা কোনোভাবেই বিয়ে করতে রাজি হননি। আমি বাবাকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব করায় বাবা প্রায় চব্বিশঘণ্টা শুধু কান্না করেছেন। তিনি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেননি স্ত্রী জীবিত থাকা অবস্থায় তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করবেন। আর সে বিয়ের প্রস্তাব তার একমাত্র ছেলের পক্ষ থেকে আসবে।
আমার বাবা- মা’র বিয়ে হয়েছে বত্রিশ বছর আগে এরকম বৃষ্টির দিনে। আমার দাদা আর নানা ছিলেন খুব ভালো বন্ধু। তারা নিজেরাই কথা বলে নিজেদের ছেলে মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছেন। বাবা ছিলেন একটা নিবন্ধিত কলেজের বাংলার শিক্ষক। খুব গদ্য করে কথা বলতে জানতেন। অসম্ভব সৎ, চরিত্রবান ও সাহসী ছেলে।
নানা এমন সৎ, চরিত্রবান ছেলেকে হাত ছাড়া করতে চাননি। যে একদম চোখের সামনে বড় হয়েছে। তিনি তার একমাত্র মেয়ের সাথে বাবার বিয়ে দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন।
আমার কলেজ পড়ুয়া সুন্দরী মায়ের কিন্তু বাবাকে একদম পছন্দ ছিল না। বাবার গায়ের রং ময়লা আর খাটো। এইটুকুই যথেষ্ট ছিল বর হিসাবে অযোগ্য হওয়ার জন্য বাবা।
মা বিভিন্নভাবে বিয়েতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। অথচ নানা সে সব কথা কানেও তুলেননি। তিনি বাধ্য হয়ে বাবার কলেজে ছুটে গিয়েছেন। মাকে যেন বাবা বিয়ে করতে রাজি না হন। অথচ সেদিন বাবা কলেজেই যাননি। মার বিয়েতে আপত্তির কারণ ছিল তাঁর এক কলেজের বন্ধুুকে তিনি পছন্দ করতেন।
নানা কোনোভাবেই অল্প বয়সী বেকার ছেলের কাছে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি না। তাঁর পছন্দ কলেজ শিক্ষক বন্ধুর ছেলেকে। তিনি একমাত্র মেয়ের পাত্র হিসাবে তাকেই উপযুক্ত মনে করছেন।
মা বিগড়ে যাচ্ছে বিয়েতে বুঝতে পেরে নানা রাতারাতি বাবার সাথে মায়ের বিয়ের ব্যাবস্থা করে ফেললেন।
ফুলশয্যার ঘরে ঘুমের ঔষধ খেয়ে মা অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। প্রায় অর্ধমৃত স্ত্রীকে নিয়ে সারারাত বারান্দায় পায়চারি করে আমার সহজসরল বাবার কেটেছে বিয়ের প্রথম রাত।
তিনি তখনও ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি, বিয়েতে তাঁর স্ত্রীর অসম্মতি ছিল।
মায়ের তালবাহান, বাবাকে দেখলে পালিয়ে যাওয়া, মধ্যে রাতে জোর করে কেউ এনে রুমে দিয়ে যাওয়া দেখে বাবা ভেবেছিলেন অল্প বয়সী মেয়ের পাগলামী। বর দেখে হয়তো ভয় পেয়েছে। বাবার অবশ্য দোষ নেই। নানা বাড়ির সবাই বাবাকে এভাবেই বুঝিয়েছেন।
আমি বড় হওয়ার পর একদিন এসব গল্প মায়ের মুখ থেকেই শুনেছি।
বাবা যেদিন সত্যি সত্যি বুঝতে পারলেন, মা বাবাকে বিন্দু পরিমানও ভালোবাসে না, পছন্দ করে না। তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
কারণ ইতিমধ্যে আমি দুনিয়ায় আসার জন্য রওনা দিয়েছি।
একটা সময় বাবাসহ সবাই ভেবেছেন, আমার জন্ম হলে হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার জন্ম হলো, আমি বড় হলাম, অথচ কিছুই ঠিক হয়নি।
আমার মা ভীষণ সুন্দরী, বুদ্ধিমতি ও চালাক ছিলেন। শ্বশুর বাড়িতে এসে তিনি শ্বশুর, শাশুড়ি, দেবর, ননদ সবার মন জয় করে নিয়েছেন। অথচ যার কারণে সবাই মায়ের আপন হয়েছে, সে মানুষটাকেই মা ভালোবাসতে পারেননি।
ছোটবেলা থেকেই দেখতাম মায়ের রুম ছিল আলাদা। সেটায় নতুন বিছানা চাদর, জানালায় নতুন পর্দার কাপড়, ফুলদানীতে নতুন ফুল। সেখানে ছোটবেলা থেকে আমি আর মা একসাথে ঘুমাতাম।
বাবা থাকতেন বারান্দার একটা রুমে। সেখানে তাঁর বই -পুস্তক, চেয়ার, টেবিল আর একটা আলমারি ছিল।
বছরের পর বছর বাবার বিছানার চাদরটা পাল্টানো হতো না।
মা শোল মাছ খেতে পছন্দ করতেন। বাজারে গেলেই বাবা সর্বপ্রথম মায়ের পছন্দের শোল মাছ নিয়ে বাসায় ফিরতেন।
বাবার পছন্দ টাকি মাছের ভর্তা। অথচ সেই টাকি মাছের ভর্তা আমাদের বাসায় কখনো করা হয়নি। বা করলেও বাবার জন্য আলাদাভাবে রাখা হয়নি।
আমি বুঝ জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখছি, রাতের খাবার আমরা মা ছেলে একসাথে খেতাম। বাবা কখন ঘরে ফিরতেন, কখন খেতেন আমরা জানি না। স্ত্রী বর্তমান থাকা স্বত্তেও বাবা সবসময় নিজের কাপড় নিজে ধুতেন, নিজের খাবার নিজে বেড়ে খেতেন।
বাবা যে একজন মানুষ তার যে আলাদা যত্নের প্রয়োজন আছে, সেটা আমার কখনো মনেই হয়নি।
মা দুনিয়ার সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলতেন, বাবাকে দেখলেই দুনিয়ার বিরক্তি তার চোখে মুখে ভেসে উঠত।
কোনো কারণ ছাড়াই মা’র দেখাদেখি আমিও বাবাকে পছন্দ করতাম না।
বাবা না ডাকলে আমি কখনো বাবার কাছে যেতাম না। বাবা ব্যস্ত মানুষ। তিনি সারা বছর ছাত্রদের পড়ান।
সন্তানের সাথে আহলাদ করার সময় তার খুব একটা নেই।
একবছর মায়ের টাইপয়েড জ্বর হয়েছিল। বাবা ছোট্ট বিড়াল ছানার মতো করে মায়ের সেবা করেছেন, যত্ন করেছেন, ভাত খাইয়ে দিয়েছেন, মাথায় পানি দিয়ে দিয়েছেন। বাবা কলেজ থেকে ছুটি পর্যন্ত নিয়েছেন মায়ের পাশে থাকার জন্য। সেবা, যত্ন দিয়ে প্রায় মৃত্যুর বাড়ি থেকে মাকে ফিরিয়ে এনেছেন বাবা।
মায়ের প্রতি বাবার যত্ন আর ভালোবাসা দেখে আমি অবাক হয়েছি।
মায়ের অসুখ হওয়ায় আমি মনে মনে বেশ খুশি হয়েছি। ভেবেছি এক উসিলায় হয়তো তাদের সম্পর্কের দূরত্বটা ঘুঁচবে।
না আমার ভাবনা সঠিক হয়নি। সুস্থ হয়ে মা আবার আগের মতো উদাসীন হয়ে পড়লেন। বাবার ব্যাপারে।
একদিন কলেজের জন্য বই কিনতে বাবা শহরের বড় লাইব্ররিতে গিয়েছিল। পথিমধ্যে ধূলিঝড়ের কবলে পড়ে বাবা প্রায় চোখ হারাতে বসেছিলেন।
কালো কালো পাথরের ছোট টুকরার মতো কিছু একটা বাবার চোখে ঢুকে গিয়েছিল কিভাবে। বাবা চোখের যন্ত্রণায় চিৎকার করছিলেন। কান্না করছিলেন। বাড়ির সবাই আমরা বাবার জন্য অস্থির হয়ে পড়ছিমাম।
কেউ পানির ঝাপটা দিচ্ছে, কেউ টটর্চলাইট দিয়ে বাবার চোখ দেখছে।
অথচ মা নির্বিকার ভঙ্গিতে রান্নাঘরে কাজই করছিলেন।
মায়ের আচরণ আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করত। কিন্তু এটা যে ভুল সেটা বুঝতে পারতাম না। বাবা যে কষ্ট পাচ্ছে সেটাও না।
মা কোনোদিন বাবার পাশে রিক্সা বা গাড়িতে পাশাপাশি বসে কোথাও যাননি।
লম্বা, ফর্সা রঙের হাই হিল পরিহিত মায়ের পাশে সাদা চেক শার্টের, মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পরিহিত বাংলার প্রফেসার বাবাকে বড্ড বেমানান লাগত।
এটা অবশ্য মায়ের মনের কথা। আমার বাবার মতো ভদ্র, ব্যক্তিত্ববান, সুদর্শন মানু্ষ খুব কম ছিল। যার চোখের দিকে তাকালেই তাঁর ব্যক্তিত্বের কারণে অন্য সবার থেকে তাঁকে আলাদা করে চেনা যায়।
বাবার সাথে আমাদের সম্পর্ক ছিল টাকার। তিনি রোজ বাজার করে দিতেন। ঘরে কার কি লাগবে, কখন লাগবে বলার সাথে সাথে সবার চাহিদা মিটিয়ে দিতেন।
বেশির ভাগ সময় সকালের নাস্তা বাইরে করতেন। দুপুরে আর রাতে ঘরে খেতেন। তবে সবার শেষে একা একা। আমরা কখনো বাবার জন্য অপেক্ষায় করতাম না।
বাবা মাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। বন্ধ মহলে, আত্মীয়-স্বজনের কাছে মায়ের গল্প করতেন। মায়ের রান্না বাবার ভীষণ পছন্দের ছিল। মায়ের কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরা, কাজল পরা চোখ, মেহেদী রাঙানো হাত সব বাবার পছন্দ।
মায়ের উদাসীনতা, মায়ের অবহেলা, মায়ের রাগ এসবও বাবার পছন্দ।
মাঝেমধ্যে বাবার কলেজের কলিগরা আমাদের বাসায় আসতেন। মা উনাদের সামনে বাবার সাথে হেসে হেসে এমন সুন্দর করে কথা বলতেন মনে হতো এমন রোমান্টিক দম্পতি পৃথিবীতে আর একটাও নেই।
এসব চিত্র দেখতে দেখতে আমি বড় হলাম। মা আমাকে বিয়ে করাতে চাইলেন। আমার নিজের কোনো পছন্দ ছিল না। বিয়ে বা স্বামী- স্ত্রীর জীবন নিয়ে আমার মনে কোনো সুখ স্মৃতিও নেই।
আমার মনে হয়েছিল মা ধনী পরিবারের সুন্দরী মেয়ে হওয়ায় সামান্য কলেজ শিক্ষক বাবাকে অবহেলা করছেন।
আমি মাকে বলছি
” মা আমি তোমার পছন্দের মেয়েকেই বিয়ে করব, তবে কোনো সুন্দরী ধনী পরিবারের মেয়েকে নয়।”
মা হয়তো বুঝতে পেরেছেন আমি কেন একথাটা বললাম। কী মনে করে মা আমার বিয়ের কোনো দায়িত্বই নেননি।
দুই বছর আগে বাবার এক ছাত্রীর সাথে বাবা আমার বিয়ে দিলেন।
আমার মনে হয় পৃথিবীতে এমন অপূর্ব রূপবতী মেয়ে আর দুটো নেই।
আর টাকা পয়সার কথা নাই বা বললাম। আমার মতো প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাকে অর্থ দিয়ে তারা কয়েকবার কিনতে পারবে।
আমি আতংক নিয়ে আমার বিবাহিত জীবন শুরু করলাম।
কিন্তু না আমার সব ভয়, আতংকে জল ঢেলে দিয়ে আমার স্ত্রী আমাকে আপন করে নিয়েছে।
এতবেশি দায়িত্বশীল, যত্নবান মেয়ে আমি দুটো দেখিনি।
আমি প্রায় রাত করে বাসায় ফিরতাম, আমি না আসা পর্যন্ত সে কখনো খেত না।
বাসায় কাপড় ধোয়ার জন্য আলদা লোক আছে। অামার স্ত্রী আমার কাপড় নিজ হাতে ধুতো। সে বিয়ের এক সপ্তাহের মধ্যে মায়ের থেকে আমার পছন্দের খাবারের তালিকা জেনে নিয়েছে।
মুনিয়া সব সময় চেষ্টা করে, আমার পছন্দের খাবার সে নিজ হাতে রান্না করতে।
বিয়ের দেড়মাসের সময় একদিন অফিস থেকে ফেরার সময় মোটরসাইকেল এক্সিডেন্ট করে আমার ডান হাতে সামান্য কেটে গিয়েছিল।
আমি নিজেই মোটরসাইকেল চালিয়ে হাসপাতালে গিয়ে হাত ব্যান্ডিজ করে বাসায় এসেছি।
আমার হাত সামান্য কেটে গিয়েছিল, অথচ মুনিয়ার সে-কি কান্নাকাটি। সে আমাকে পরের দিন থেকে একগ্লাস পানি পর্যন্ত নিজ হাতে খেতে দেয়নি।
আমি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত সে রোজা রেখেছে, নফল নামাজ পড়েছে।
এমন সুন্দর, পবিত্র আর স্বর্গীয় ভালোবাসার রূপ আমাদের বাসায় কখনো ছিল না।
স্ত্রীর এমন নির্ভেজাল ভালোবাসায় বিয়ের পর আমার প্রতিটা দিন যেন স্বপ্ন সুখে ভরে উঠেছিল।
আমরা বাসায় চারজন ব্যক্তি আমি, মুনিয়া আর বাবা-মা।
দুই জোড়া দম্পতী আমরা। অথচ দুজনের বিবাহিত জীবনের আকাশ পাতাল ব্যাবধান।
বাবা দেখতেন আমাদেরকে, মাও দেখতেন। অথচ কখনো কিছু মুখ ফুটে বলতেন না।
বাবা একদিন মুনিয়াকে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিতে দিতে বললেন
” এভাবেই ছায়া হয়ে আমার ছেলেটাকে আগলে রাখিস মা। আমি তোর জন্য প্রাণ ভরে দোয়া করে দিলাম।”
প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, স্বল্পভাষী বাবার চোখের পানি দেখে আমার বুকের ভেতরটা সেদিন হু হু করে কেঁদে উঠল।
আমার বাবারও স্ত্রী ছিল, সন্তান হয়েছে, সংসার হয়েছে, তিনি বাড়ি করেছেন, গাড়ি কিনেছেন। কিন্তু সংসার যে একটা স্বর্গীয় সুখের স্থান এটা তিনি কখনো অনুভব করতে পারেননি।
বাবা গত বছর চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। আব্বার কলেজ সরকারি হয়েছিল পরবর্তিতে। তিনি এককালিন অনেক টাকা পেয়েছেন। প্রতিমাসে পেনশন পাচ্ছেন।
আল্লাহর রহমতে তার টাকা পয়সার অভাব নেই। অথচ বাবার প্রায় পেট খারাপ হয়। উল্টা পাল্টা কিছু খেলেই যখন তখন কাপড় নষ্ট হয়ে যায়।
তিনি কাউকে কিছু না বলে নিজে নিজে আবার এগুলো পরিষ্কার করে রোদে দেন।
একদিন আমি মাকে গিয়ে প্রস্তাব করেছিলাম
” আগে বাবার চাকরি ছিল, তিনি ছাত্রদের পড়াতেন, যখন তখন ছাত্ররা আসত। সেকারণে বাবার আলাদা রুম ছিল। এখন আর বাবার আলাদা রুমের কী দরকার।
তুমি আর বাবা আমার বড় ঘরটাতেই থাক। আমি দক্ষিণের ঘরে থাকব মুনিয়াকে নিয়ে।”
কী মনে করে ছেলের বউয়ের সামনে মা কোনো আপত্তি করেননি।
আমার বাবা বিয়ের বত্রিশ বছর পর স্ত্রীর সাথে একই বিছানায় শোয়ার অধিকার পেয়েছেন।
প্রথম প্রথম বাবা একটু আপত্তি করেছেন। আমি বুঝতে পেরেছি এটা বাবার অভিমান ছিল।
বাবা মনে মনে ভীষণ খুশি। এই খুশি বাবার বেশিদিন থাকেনি।
প্রায় তাদের মধ্যে উচ্চ বাক্য দেয়াল ভেদ করে বাইরে চলে আসে।
বাবা রাত জাগে কেন? মায়ের আপত্তি। বাবা বই পড়ে কেন? মায়ের আপত্তি? বাবা ফ্যান চালায় কেন? মায়ের আপত্তি।
বাধ্য হয়ে পনেরো দিনের দিন বাবা আগের রুমে ফিরে গেলেন।
সন্তান হয়ে এই বয়সে তাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আমি আর কি বলব।
আমি মুনিয়ার সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি বাবাকে আবার বিয়ে করাব।
আমার বাবা সামর্থবান পুরুষ। তার অর্থ-সম্পদ আছে।
স্ত্রীর সঙ্গ ও সেবা পাওয়ার অধিকার তাঁর আছে।
মুনিয়ার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় আছে। সন্তান না হওয়ার অজুহাতে তার স্বামী তাকে ত্যাগ করেছে। আমি তার সাথে কথা বলে বাবার বিয়ে ঠিক করেছি।
বাবা প্রথমে ঘোর অপত্তি করেছেন।
এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আমার মনে হয়েছে মাকে শিক্ষা দেয়ার জন্য এটাই করা উচিত।
আমি আর মুনিয়া রাতদিন করে বাবাকে বুঝিয়ে রাজি করিয়েছি।
আজ সে মাহেন্দ্রক্ষণ এলো। আজ আমার বাবার বিয়ে।
মুনিয়া আগেই ফুলশয্যার ঘর সাজিয়ে রেখেছে মাকে দেখিয়ে। বাবা আর নতুন মায়ের রুমের জন্য আমি পাপোশ থেকে শুরু করে জানালার পর্দা পর্যন্ত নতুন কিনে রুম সাজিয়েছি।
তাজা ফুল দিয়ে মুনিয়া ঘর সাজাল।
নির্বিকার ভঙিতে মা সব দেখছেন। অথচ একটা শব্দ করছেন না।
সন্ধ্যা সাতটায় আব্বা পাঞ্জাবি,পাজামা, মুনিয়া শাড়ি আমি ব্লেজার পরে রেডি হয়ে বসে আছি।বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে।
বৃষ্টি কমলেই আমরা বেরিয়ে যাব বাবার নতুন স্ত্রীকে আনার জন্য।
বাবার সারা গায়ে মিষ্টি পারফিউমের গন্ধ আসছে। সুন্দর পরিপাটি করে চুল, দাড়ি কাটানো বাবাকে ক্রীম কালারের পাঞ্জাবিতে ত্রিশ বছরের যুবকের মতোই আকর্ষনীয় লাগছে।
বাবা এভাবেই সেজেগুজে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন মায়ের কাছে।
” জাহানার আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। আসলে বিয়ে নয়। বিয়ে আমার বত্রিশ বছর বয়সে তোমার সঙ্গেই হয়েছে। আমি একজন সেবিকা আনতে যাচ্ছি। যে আমার সাথে থাকবে, গল্প করবে, পান বানিয়ে দেবে। একসাথে বসে বই পড়বে, টিভি দেখবে।
স্বীকৃতি দেয়া ছাড়া তো সেটা সম্ভব নয়।তোমার কোনো অসুবিধা আগেও হয়নি, এখনো হবে না। টাকা পয়সা লাগলে জানাবে।”
বাবার কথা শেষ না হতেই প্রচণ্ড জেদি আর অহংকারী আমার মা খপ করে আমার বাবার দুহাত জড়িয়ে ধরে বললেন
” আপনি কোথায়, কিসের স্ত্রী, কার অনুমতি নিয়ে আনতে যাচ্ছেন। আমি কি মরে গেছি যে আপনাকে সেবিকা আনতে হবে?”
মা উচ্চ স্বরে বাবার হাত ধরে আমাকে ডাকতে ডাকতে বললেন।
” রাকিব, মুনিয়া কোথায় তোমরা? কেউ কোথাও যাবে না। তোমরা তোমার বাবাকে নিয়ে ঘরে যাও। আমি এখুনি আসছি।”
আমরা রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই বাবা মাকে আড়াল করে আমাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন।
রাত এগারোটা বাজে বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। আমি আর মুনিয়া বারান্দায় বসে আছে। বৃষ্টির পানিতে আমি ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছি।
আমি মুনিয়ার হাত ধরে কাছে টেনে কপালে গভীর চুম্বন এঁকে দিলাম। এই পাগলি মেয়েটার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নাই। ওর পরিকল্পনায় আমি বত্রিশ বছর পর আমার বাবা মাকে নতুন রূপে ফিরে পেয়েছি।
হঠাৎ মুনিয়া হাসতে হাসতে বলল
” আর ঢং করতে হবে না। চলো বাবা মায়ের ব্যাগ গুছিয়ে রাখি। সকাল সাতটায় ফ্লাইট। আমি আগেই টিকেট কেটে রেখেছি। কক্সবাজারে হোটেলের সিটও বুক করে রেখেছি। বাবা -মা হানিমুনে যাবেন কক্সবাজার।
কামরুন নাহার মিশু – কবি ও সাহিত্যিক।