Take a fresh look at your lifestyle.

বিদিশা- এক

190

 

বুকের উপর হালকা মেশিনটা যখন চলছিল ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে ,, বিদিশা তখন বুঝতে পারল তার সারা শরীর ঝিমঝিম করছে ।। অন্যান্য সময় বুকের মধ্যে ঝিমঝিম হাত-পা ঝিমঝিম করে কিন্তু এই সারা শরীর ঝিমঝিমের সময় ওর মনে একটু ভয় হচ্ছিল।। প্রায় আধা ঘন্টা ধরে মেশিন চলাকালীন তার পুরনো অনেক কথা মনে পড়ে গেল।। কতদিন হাঁটতে পারে না সে,, একটু সময় হাঁটলেই হাত পা গুলি অবশ হয়ে যায়।। চোখ মাথা আঁধার হয়ে আসে বহুদিন থেকে ।। কাশি আর জ্বর চির সাথী হয়ে গেছে তার জীবনে ।।মেয়ে মানুষের শরীরের গভীরে ক্যান্সারের উপসর্গ অনেক কিছুই সে বুঝতে পেরেছে অনেকদিন ধরে।। বুকের মধ্যে প্রচন্ড কষ্ট তার।। আরো বেশি কষ্ট না পাওয়ার অনুভূতি গুলির জন্য ।। সংসারে নিজেকে বিলিয়ে দেবার পরও পরিবারের মানুষ যখন তার অসুস্থতার দিকে কেউ নজর দেয়নি এতদিন ,, তাই আজ তার এই অবস্থা ।।

এখন তার শুধু একটা চাপা কষ্ট প্রতিনিয়ত তাকে সাংঘাতিকভাবে খুরে খুরে খায় ।
তার স্বামী কোনদিন তার এতোটুকু খেয়াল রাখলো না।। হয়তো তার জীবনে অনেক ভালো একটি ছেলে আসতে পারতো।। ওই যে বিদিশার অল্প বয়সে মারাত্মক একটি ভুল যার জন্য তার কপাল সে নিজেই পুড়িয়ে নিয়েছে।। বিয়ে করা তার অনেক বড় একটা ভুল ছিল।। যাকে জীবনের সবথেকে আপন ভেবে তার সাথে গাঁটছড়ায় নিজেকে বেঁধে ছিল …. হিন্দু শাস্ত্রে যাকে আমরা স্বামী বলি, সেই স্বামী তাকে সাংঘাতিকভাবে ঠকিয়েছে!! তাকে শুধু ভোগ করেছে তার উপর অত্যাচার করেছে তাকে শাসন এবং শোষণ চালিয়েছে !! সেই স্বামী তার জীবনে সবচেয়ে বড় আসামী হয়ে দাঁড়িয়েছে।।সে কথাগুলি সে কখনো ভুলতে পারবে না।।

লেখাপড়ায় খুব ভাল ছিল বিদিশা ।। কিশোরী অবস্থায় দেখতেও বেশ সুন্দর ছিল ।। তবুও অশিক্ষিত এক ছেলেকে… সৌন্দর্যের কথা নাই বা ধরা হলো,, তবুও কি রুচিতেই যে ওই ছেলেকে সে পছন্দ করেছে সেই কথা ভাবলে এখন তার চোখে জল ছাড়া কিছুই আসে না ।। তারপর এত অত্যাচার সহ্য করেও সে কেন সময় থাকতে বেরিয়ে আসতে পারেনি তার জন্য ভীষণ আফসোস হয় তার ।।আজ সে শারীরিক এবং মানসিক উভয়দিকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে।।

এই কথাগুলি ভাবছে আর ডাক্তারের চেম্বারে শুয়ে দুচোখ থেকে জল ঝড়ছে ,, এমন একজন জীবন সাথীকে সে নির্বাচন করেছিল তার সাথে যোগ্যতা,, আদব-কায়দা,, মনের মিল,, কোনটাতেই কোন মিল নেই।। সে এখন হাসতে ভুলে গেছে ।। স্বামীর সাথে নাকি বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, সেই স্বামীর সাথে বিয়ের কিছুদিন পরই বুঝতে পারল বন্ধুত্ব তো দূরের কথা… মন খুলে একটা কথাই বলা যায় না!! সেই পুরুষের টাকা নেই ,, স্ট্যাটাস নেই ,, কোন যোগ্যতা কিছুই গুণ নেই,, অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে যখন তখন,, সেই পুরুষ।। স্ত্রীকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় যখন তখন।।

তাই বিদিশা সন্তানদেরকে সাথে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েও এসেছিল একদিন।। নিজের যোগ্যতায় ক্ষমতায় পরিশ্রম করে একটি বাড়িও বানিয়েছিল।। তবুও তার জীবনে শান্তি নেই।। সেই পুরুষ আবার এসেছে তাকে জ্বালাতে।। সেই পুরুষ স্ত্রীকে হাতের পুতুল ভাবে।। স্ত্রীকে বাড়ি থেকে বের হওয়া হবে না ,, আত্মীয়দের সাথে কোন সম্পর্ক রাখা হবে না।

সন্তানেরা যখন ছোট ছিল বাড়ির গেটের বাইরে রাস্তায় নিয়ে বেরোলে ,, এসে দেখতে পেলেই তাকে জবাবদিহি করতে হতো ।। এদিকে বাড়িতে ছিল শুধুই অন্ধকার।। বিদ্যুৎ নেই,, খাদ্যের ভীষণ অভাব ,, শান্তি নেই,, শুধু আছে টর্চার আর মানসিক যন্ত্রণা।।

সন্তানদের কথা মাথায় রেখে সে আত্মহত্যা করতে পারেনি।। ভবিষ্যতে ওই সন্তানেরা বড় হয়ে মাকে দোষারোপ করবে বলে স্বামীকেও সে ডিভোর্স দিতে পারেনি।। যে মেয়েকে বাড়ি থেকে বের হতে দেওয়া হয় না ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে প্রশাসনের দ্বারস্থ হবেই বা কি করে?? প্রতিবেশীরাও অন্যের সংসারের ব্যাপারে কিছু বলার সাহস পায় না কারণ সেই পুরুষের মুখের অকথ্য ভাষার ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করতেও এগিয়ে আসে না।। তাই বিদিশা পড়ে পড়ে সংসারে মার খায়।। প্রশাসনের দ্বারস্থ হলেই কি সেখানেও যে অনেক হ্যাপা, পেটে বিদ্যা আছে বলে এটুকু সে ভালোই বুঝেছিল বাঘে ছুলে ১৮ ঘা আর পুলিশ ছুলে ৩৬ ঘা। তাই সহজে সে থানা পুলিশ করেনি।।

সন্তানেরা বড় হওয়ার পর বিদিশা নিজের মতো বাড়ি করে সেখানে বসবাস করতে শুরু করার পরও তার স্বামী তার ওপর প্রচণ্ড অত্যাচার চালায় সেই বাড়িতে গিয়েই ।। তখন বাধ্যতামূলক বিদিশা প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়।। পুলিশ তার স্বামীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর ওর মনে স্বামীর প্রতি তবুও দুর্বলতা থাকে তাই স্বামীকে কারাগার থেকে ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করে।। এরপর থেকে তার স্বামী আর তার গায়ে হাত দেওয়ার সাহস পায়নি কোনদিনও।। একবার বাবা মায়ের মুখে চুনকালি দিয়েছে তাই আর মা বাবা কেউ কোনোভাবেই সে ছোট করতে চায় না তাই সব জ্বালা শুধু সহ্য করে চলে।। একদিন তার স্বামী ভালো হবে,, ভালোভাবে ,, এই ভেবে সব সহ্য করে গেছে।। এতদিন পর এখন বুঝতে পারে এই সব মানুষ জীবনেও ভালো হয় না।। বউকে পেটানোটায় শুধু বন্ধ হয়েছে ঠিকই,,একটু নরম হয়েছে ঠিকই,, কিন্তু ওদের অহংকার আর স্ত্রীর প্রতি অমর্যাদা একই রকম থেকে যায়।।

এই ভাবতে ভাবতেই ডাক্তার মেশিন সরিয়ে,, অন্য ঘরে চেকআপে নিয়ে গেলেন ।।এখন স্বামী গেছে স্ত্রীর সাথে
।। সহ্যের সীমা যখন তুঙ্গে বিদিশা তখন তার স্বামীকে জোরপূর্বক নিয়ে গেছে ডাক্তারের নিকট ।। নানান মেশিন দিয়ে পরীক্ষা করা হলো বিদিশার শরীরে ধরেছে নানান ব্যাধি। বুকের মধ্যে শক্ত হয়ে থাকা এবং শারীরিক অনেক সমস্যা দেখা দিয়েছে।। অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে ,, শারীরিক অত্যাচার হওয়ার কারণে,, গাইনর এবং সার্জনের সমস্যাও দেখা দিয়েছে। দিনের পর দিন না খেয়ে থাকার ফলস্বরূপ আজকে শরীরে ধরেছে কঠিন ব্যাধি।।এই মুহূর্তে যদি সঠিক চিকিৎসা না হয় ভবিষ্যতে মারাত্মক অবস্থা সম্মুখীন হতে হবে।।

ডাক্তার বললেন আর বিদিশার স্বামী শুধু শুনে গেলেন ডাক্তারের কথাগুলি।। ডাক্তার দেখানো হল ওষুধ কিন্তু তার স্বামী এনে দিলেন না অথচ ঐ শরীর নিয়েই সে স্বামীকে হাত পুড়িয়ে ভাত রেঁধে খাওয়ায় ।। স্ত্রীর জন্য একবার আফসোস হয় না তার।। ওষুধ বাড়িতে এলো ঠিকই ডাক্তার দেখাবার তিনদিন পর।

 

……… চলবে

 

পম্পা – কবি, লেখক ও সাহিত্যিক।

Leave A Reply

Your email address will not be published.