ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে।কাল রাত থেকেই। একনাগাড়ে। মা সকালে উঠেই বলে দিল…. ” আজ আর স্কুলে যেতে হবে না এত বৃষ্টি মাথায় নিয়ে”। শুনে কান্না পাচ্ছে রুমকির। মা যেন কি …… ? বোঝেই না। এই বৃষ্টিতে ই তো মজা। ওই যে নরেনকাকুর সেলুনের সামনের রাস্তায় এত্ত এত্ত জল জমে আছে, ওখান দিয়ে ওই জল ছপছপ করতে করতে যাওয়ার যে কি মজা! মাটি হয়ে যাবেনা কি? তারপর আর একটু এগিয়ে গেলেই স্কুলের একটু অাগেই ওই যে শিবতলায় বটগাছটার নিচে দিয়ে ……… অ…নে…ক জল…. বন্ধুদের সঙ্গে ওর ওপর দিয়ে যাওয়ার আনন্দ…….. রুমকির মনটা চঞ্চল হয়ে উঠল। ইস্…. যে করেই হোক মাকে মানাতেই হবে। বিশেষ করে মালতিদিদিদের পুরো দলটা রুমিকে ডাকতে আসে…….. একসাথে যাবে বলে। আর কে না জানে, আজকে তো স্কুলে বেশী পড়াশোনা হবেই না। কম ছাত্র ছাত্রী আসলে নতুন বিষয় শুরু হবেনা, সারাদিন অনেক খেলার সময়সুযোগ পাবে বন্ধুদের সঙ্গে। অনেক প্রাণখুলে গল্প করা যাবে। আর ইতি, জেবু, রীনা, শ্যামলী কে বললে একসাথে স্কুলে র পেছনের ওই আশ্রমের বাঁধানো গাছের নিচে বৃষ্টির ছাঁট খেতে খেতে …. ….. ওহঃ….. রুমকি আর ভাবতেই পারছেনা….কি মজা ….।
চলল রুমকি স্কুলের পথে। মাকে মানিয়ে নিয়েছে কোনো রকমে। কিন্তু অঘটনটা ঘটেই গেল ওই বাঁশতলা তেই। জলের উপর ছপছপিয়ে চলতে চলতে গল্প আর হাসি …… হঠাৎ করে তারপর রুমকির পা পিছলে গেল। একেবারে পড়ে গিয়ে জামাকাপড় জলে সপসপে। বন্ধুরা বলল…..”আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, তুই বাড়ী গিয়ে জামাকাপড় বদলিয়ে তাড়াতাড়ি চলে আয়…. আজকে আমের মোরব্বা এনেছি, সব্বাই একসাথে খাব।”
রুমকি চলল বাড়ীর পথে। মনটা একটু খারাপ। যদিও বাড়ী কাছেই, বেশীদুর আসেনি। কিন্তু দেরি করা চলবেনা।একটু তাড়াতাড়ি পা চালাল সে। ঘরে গিয়ে দেখল মায়ের তখনো গৃহকাজ সারা হয়নি, রান্না ঘর পরিষ্কার করছে। অবাক হয়ে গেল মা …… কিন্তু রুমকির মুখের দিকে তাকিয়ে মায়ের বোধহয় মনটা নরম হয়ে গেল। জল হাতটা আঁচলে তাড়াতাড়ি মুছে নিয়ে মা ওর জামাকাপড় বদলানোতে হাত লাগাল। তারপর আর দেখে কে রুমকিকে। মায়ের নীরব সম্মতি তো সে পেয়েই গেছে। আর বৃষ্টিটা একটু কম হচ্ছে এখন। একটু তাড়াতাড়ি পা চালালেই হবে। এইভেবে সে খুউব সাবধানে চলল …. বাঁশবাগান তো নিরাপদেই পার পরে গেল। মালতীদিদিদের তো দেখছিনা? ওরা কি অনেক দূরে এগিয়ে গেছে? একটু জোরে পা চালালো রুমকি, সাবধানেই….. কিন্ত ওই শিবতলায় এসে বটগাছের নিচে দিয়ে যাওয়ার সময় আবার পা পিছলে গেল। আর এবার একদম পুরো সটান। ব্যাগ, ছাতা সব ছত্রাকার। চোখে জল এসে গেল রুমকির। আজ আর স্কুলে যাওয়া হবেনা তার। আর একটু গেলেই স্কুল। বাড়ি অনেক দূরে এখন। কিন্তু এই কাদামাখা অবস্হায় ও স্কুলে যাবে কি করে?
কাঁদতে কাঁদতে চলল বাড়ীর পথে রুমকি। এবার তো মায়ের বকুনিও খেতে হবে তাকে। সকালেই মা মানা করেছিল স্কুলে যেতে। তাও অনেক সাধ্যসাধনা করে ও রাজী করিয়েছিল মাকে, কিন্ত আর কি সে ছাড় পাবে? সব থেকে এটা ভেবে কষ্ট হচ্ছে রুমকির যে আজ শুক্রবার….. প্রথম দুটো পিরিয়ড ই “খেলা” …. এই দিন দিদিমনি দের কি একটা জরুরী সভা হয়, তাই এই ব্যাবস্হা —- আর আজকেই সে কিনা যেতে পারলোনা স্কুলে? চোখের জল বাঁধ মানছেনা।
ঘরে ফিরে দেখল — এতক্ষনে মা খেতে বসেছে। রুমকিকে দেখে তো মা অবাক। ” কিরে ….. আবার পড়ে গেলি? জলকাদায় কি দৌড়তে হয়? আর যেতে হবেনা সোনা। জামাকাপড় ছেড়ে ফেল”।
রুমকি কি অবাক হয়ে যাবে? মা কেন একটুও বকছেনা তাকে? সে তো মায়ের কাজও অনেক বাড়িয়ে দিল এই বৃষ্টির দিনে। এতগুলো জামাকাপড় কাচতে হবে। কিন্তু মা তাকে কাছে ডেকে মাথায় হাত বোলাচ্ছে……. কিচ্ছু বুঝতে পারছেনা রুমকি।মায়ের কি নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল? মাও কি তার মত এরকম বৃষ্টিতে ভিজতে ভালবাসতো? চোখের জল আর বৃষ্টির জল এক হয়ে যাচ্ছে…… মায়ের হাতটা কি নরম……….
…………. ঘুম ভেঙে গেল রুমকির। মধ্যপ্রদেশের এন. টি.পি. সি র এই কোয়ার্টারে “রুমকি “ওরফে অনিন্দিতা এখন একা। দুপুরে ভাত খাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে শুয়ে গান শুনতে শুনতে একটু চোখ লেগে গিয়েছিল। স্বামী অফিসে। মেয়েরা স্কুলে। ধড়মড় করে উঠে পড়ল রুমকি। স্হির হয়ে বসল একটু। কড়কড় করে বাজ পড়ল কাছে পিঠে কোথাও। তারপরেই ঝমঝমিয়ে আকাশ ভাঙা বৃষ্টি। রুমকি মাথার চুলটা দুহাতে তাড়াতাড়ি এলো খোঁপা করতে করতেই দৌড় লাগালো বারান্দায়। ততক্ষনে জামাকাপড় সব ভিজে গেছে।
শম্পা গাঙ্গুলী ঘোষ- গল্পাকার, গুজরাট।