আজ আমি খুব খুশি কারণ অনেক দিন ধরে ইডেন কলেজের হোস্টেল এর খাবার খেতে খেতে ভালো খাবারের স্বাধ ভুলে গেছি। তাই তিন দিনের ছুটিতে নবীনগর ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে যাচ্ছি। আমরা দুই ভাই বোন ,ভাই বড় আমি ছোট। ভাই টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার ও একটা টেক্সটাইল কোম্পানিতে চাকুরি করে আমি সেখানেই যাচ্ছি। ভাইয়ের একটা ছোট্ট টুনটুনি পাখির মতন মেয়ে আছে আর সেটাই আমার সবচেয়ে বেশি প্রিয়।
ভাই দেখতে যতটা ফর্সা আমি ঠিক তার উল্টো। ছোট বেলা থেকেই গায়ের রঙ নিয়ে নানা কথা শুনতে শুনতে আমি বড় হয়েছি। গায়ের রঙটাই যেন আমার সবচেয়ে বড় অন্তরায়। যেখানে যাই এক কথা মেয়েটার চেহারা ভালো কিন্তু রঙটা একটু বেশি কালো। যেখানে যাচ্ছি সেখানে গেলেও ঐ একই বিড়ম্বনা ওখানে আবার বিশাল গেট। সেখান থেকে গেট পাস নিয়ে নাম পরিচয় দিয়ে ভেতরে যেতে হয়। গেটে গিয়ে ভাইয়ের নাম বলতেই আপনি মনির সাহেবের বোন চেহাড়ায় কোন মিল নেই। উনি তো খুব ফর্সা কিন্তু আপনাকে দেখে তো মনেই হচ্ছে না আপনি ওনার বোন। আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করলাম আমি কালো তার জন্য।
আবার আমার বাবা মাকে দেখেও সকলের ঐ একই প্রশ্ন মেয়ে কার মতো হয়েছে গায়ের রঙটা একটু বেশি কালো। অনেকের এমন অবাক করা প্রশ্নের উত্তরটা অনেক সময় আমিই দিয়ে দেই।যখন বাবার হাত ধরে কলেজে ভর্তি হতে যাই কলেজের এক শিক্ষক এর সাথে বাবার খুব খাতির। বাবা কলেজে গিয়ে সেই শিক্ষককে বললেন মেয়েকে আপনার কলেজেই ভর্তি করতে নিয়ে আসলাম আমার ছেলেও তো এই কলেজেরই ছাত্র ছিলো। কলেজের শিক্ষক আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলছে তোমার ভাইটা তো খুব সুন্দর ছিলো দেখতে। এটা বলেই বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলছে মেয়ে কি মায়ের মতো দেখতে হয়েছে? সেদিন আমার ভেতরে ভেতরে খুব রাগ হয়ে ছিলো। আমি একটু কড়া ভাষায় বললাম জানেন স্যার সাদা ডিমের মধ্যেই কিন্তু কালো বাচ্চার জন্ম হয়।
কিন্তু আমার গায়ের রঙ নিয়ে আমার এবং আমার বাবার কোন সমস্যা ছিলো না। আমার বাবার কাছে আমি পৃথিবীর সব চেয়ে সুন্দরী এক কথায় রাজকন্যা।
আমার পোশাক কিনতে গেলে সকলের কি ঝামেলা খালা ফুপুরা সবাই বলে মার্কেটে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গেছি কোন রঙটায় তোকে ঠিক মানাবে বুঝতেই পারছিনা। আমার পছন্দের রঙ কালো। কারন আয়নার সামনে যতোবার কালো ড্রেস গায়ে দিয়ি দাড়িয়েছি দেখি আমাকে খুব সুন্দর লাগছে। বাবা আমার জন্য সব সময় কালোর মধ্যে গোল্ডেন কালারের সুতার কাজ করা, কালোর উপর প্রিন্ট এই ধরনের সালোয়ার কামিজ কিনে দেয় আমার ভীষণ ভালো লাগে। আমি কখনো মেকাপ করিনা এমন কি পাউডারও না। কখনও ছবি এডিট করিনা আমি যেমন অবিকল তেমনি থাকতে চাই। তবে শখ করে যদি কখনও শাড়ি পড়ি তাহলে খোঁপায় একটু খানি ফুল গুঁজে দেই এটা আমার খুব ভালো লাগে। এই হচ্ছে আমি……
সেদিন ভাইয়ের বাসায় যাবার সময় গাবতলী থেকে বাসে উঠলাম আমার সহযাত্রী হলেন একজন বয়স্ক মহিলা উনি যাবে মানিকগঞ্জ। ভদ্রমহিলা একটা প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করে। ওনাদের একটাই ছেলে পড়ালেখা শেষ করে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে মাত্র চাকুরি শুরু করেছে। এসব পরিচয় উনি নিজের থেকেই আমার কাছে দিয়ে গেলেন। আমার বিশেষ কোন কৌতূহল নেই এসব শোনার। আর আমার ব্যাপারে উনি যা যা জিজ্ঞেস করছে ঠিক ততটুকুই আমি বলেছি। তাছাড়া আমি তো বেশি আলোচনায় যাবো না। কারন কখন আবার আমার গায়ের রঙ নিয়ে কথা উঠবে এই ভয়ে। সেদিন ছিলো প্রচণ্ড যানজট বাস মোটেই চলছে না। ভদ্রমহিলা ইতিমধ্যে এক হাজার প্রশংসা করে যাচ্ছে ওনার ছেলেকে নিয়ে। আমার কিন্তু ভালোই লাগছে উনি ওনার ছেলেকে কতো ভালোবাসে এটা ভেবে। হঠাৎ উনি আমার হাত খানা ওনার হাতের মধ্যে নিয়ে বলছে মা তুমি তো দেখতে অনেক সুন্দর। কি সুন্দর চেহারা, মায়া ভরা মুখ, কি লম্বা চুল। তুমি যখন বাসে উঠছিলে আমি তখন থেকেই তোমাকে দেখছিলাম। তুমি দেখতে দারুন আমার ছেলের সাথে দারুন মানাবে। আর আমার ছেলে ,আমি যে মেয়ে কে পছন্দ করবো ওর সেটাই পছন্দ।
আমি কোন উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না কি বলবো ওনাকে? আমি আস্তে করে বললাম আপনি মনে হয় ভালো করে আমাকে দেখতে পাননি আমি যে খুব কালো। উনি একগাল হেসে দিয়ে বললেন ধুর বোকা মেয়ে কালো তো বাইরে ভেতর তো কালো নয়। আমিও খুব হাসলাম আর ভাবতে থাকলাম। সত্যি তো মানুষের ভেতর তো কালো নয়। কিন্তু কী মুশকিল উনি তো আমাকে কিচ্ছু বলার সুযোগই দিচ্ছে না।
হঠাৎ আমার ফোন বেজে উঠলো বাসে খুব শব্দ আমি হেড ফোন কানে দিয়ে কথা বলছিলাম।কথা শেষ হলে ভদ্রমহিলা মনে করেছেন আমি আমার মায়ের সাথে কথা বলছি। ওমনি বললেন আবার ফোন করো তোমার মায়ের সাথে কথা বলি। আমি খুব উৎসাহ নিয়ে বললাম ঠিক আছে এখনই দিচ্ছি। কারন জীবনের প্রথম কেউ আমাকে এত সুন্দর চোখে দেখতে পেল। আমি কল দিয়ে হেড ফোনের একটা তার ভদ্রমহিলার কানে আর একটা তার আমার কানে দিলাম। ফোন রিসিভ হলো আমি সালাম দিয়ে বললাম মা একজন ভদ্রমহিলা আপনার সাথে কথা বলবে।
মা বললেন দাও কথা বলি। উনি তো খুব সুন্দর করে সালাম বিনিময় করে বলছে আপা আপনার মেয়েটা এত সুন্দর আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমি আমার ছেলের বউ করতে চাই। আমার ছেলে খুব সুন্দর, আপনার দেখলেই পছন্দ হবে।
ফোনের ওপাশ থেকে হাঁকিয়ে উত্তর আমার ছেলেও দেখতে খুব সুন্দর। আর আপনি যার কথা বলছেন সে আমার ছেলের বউ। কথা শেষ ভদ্রমহিলার খুব মন খারাপ। আমি বললাম খালাম্মা আমি খুব দূঃখিত। আপনিই তো আমাকে কিছু বলার সুযোগই দিলেন না। আমি হতবাক আমি এত কালো কিন্ত ওনার সুন্দর চোখ দিয়ে দেখতে পেল না। অন্য দিকে আমার শাশুড়ি আমার গায়ের রং কালো দেখে দুই ঘন্টা গাড়িতে বসিয়ে রেখেছিলো। আমার শাশুড়ি ,আমাকে ছেলের বউ হিসাবে মানতে পারছিলো না। তাই তো আপনার সাথে কথা বলিয়ে দেবার একটাই উদ্দেশ্য; আপনি ওনাকে বোঝাতে পেরেছেন গায়ের রঙ কখনও মানুষের জীবনের সত্যিকার সৌন্দর্য্য না। তার ভেতরটাই আসল। ভদ্রমহিলার সাথে কথা বলতে বলতেই আবার ফোন বেজে উঠলো। ফোন ধরেই দেখছি ; আমার শাশুড়ি কি ভয়ানক ব্যাপার!! আমি ফোন ধরেই বললাম জ্বি মা বলুন; শোন তোমার পাশে যে ভদ্রমহিলা বসে আছে সম্ভবতঃ উনি চোখে ভালো দেখতে পায় না। আমি খুব ভারি কন্ঠে বললাম তবে তাই হবে। কোথায় আমি ভাবলাম আমার কদর মনে হয় একটু খানি বাড়বে? এখন দেখি সব আগের মতোই।
যখন আমি বাস থেকে নেমে যাবো; তখন ভদ্রমহিলা বলছে ; তুমি অনেক সুন্দর, তুমি কালো নও। কালো হচ্ছে মানুষের মন,আর দেখার দৃষ্টি ভঙ্গি। আফসোস! তোমার আর আমার দেখা হলো, কিন্তু একদম বেলাশেষে। বাস থেকে দূজনেই নেমে পড়লাম অনেক দুর পর্যন্ত হাত নেড়ে বিদায় জানালাম কিন্তু ফোন নম্বর টাই নেওয়া হলো না।
ইসরাত জাহান- কবি ও সাহিত্যিক।