মা তোমার কি মাছ খেতে ইচ্ছা করছে? তোমার জামাইকে বাজার থেকে সেই মাছ আনতে বলবো।
অনেক দিন পর মা আমার বাড়ি বেড়াতে এসেছে। আমার খুবই আনন্দ হচ্ছে। মাকে কি খাওয়াবো, কোথায় নিয়ে ঘুরতে যাব সারাক্ষণ মাথার ভিতর এই চিন্তা।
মা কোনো কথা না বলে চুপ করে আছে।কি হলো মা বলো কি মাছ কিনব?
লাজুক হেসে মা আস্তে করে বলল, মাগো যদি সম্ভব হয় তাহলে বড়ো ইলিশ মাছ কিনতে পারো। সেই বিয়ের আগে বড়ো ইলিশ মাছ খেয়েছি আর খাইনি।
আমার বাবা সরকারি চাকরি করতেন কোনোদিন ঘুষ খাননি যা বেতন পেতেন আমাদের দুবোনের লেখাপড়ার খরচ যুগিয়ে কষ্টেসৃষ্টে সংসার চলতো।
এখন আমরা দুবোনই পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করি, মা যা খেতে চাইবে তাই খাওয়ানোর সামর্থ্য আমাদের আছে। আফসোস বাবাকে খাওয়ানোর সুযোগ হলো না হঠাৎ স্ট্রোক করে দুই বছর আগে বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।আমাদের দুবোনেরই বিয়ে হয়ে গেছে।বাবা মারা যাওয়ার পর মাকে খুব অনুরোধ করি আমার আর চম্পার কাছে থাকার জন্য।
মা করুণ মুখ করে বলে, মাগো স্বামীর ভিটে ছেড়ে কোথাও যেয়ে শান্তি পাই না। যতদিন সক্ষম আছি ততদিন স্বামীর ভিটেয় থাকি, অক্ষম হয়ে গেলে তখন তো তোমাদের কাছে থাকতেই হবে।
আমার স্বামী বেশ বড়ো একটা ইলিশ মাছ কিনে এনেছে।মার চোখ খুশিতে চকচক করে উঠল।মা গভীর আগ্রহে মাছটার গায়ে হাত বুলাচ্ছে হঠাৎ বলে উঠল, জানিস সম্পা আমার আব্বাও ঠিক এই রকম বড়ো ইলিশ মাছ কিনতেন।গ্রামে সপ্তাহে হাট হয় দুই দিন, ঐ দুই দিন বাজার হতো। তখন ইলিশ মাছের সের ছিলো কুড়ি টাকা। আব্বা মাছ বাড়িতে এনেই আমাকে ডাক দিয়ে বলতেন, খুকি মাছটা সুন্দর করে কাটো, আমার মাছ কাটা আব্বার খুব পছন্দ। হঠাৎ একদিন মাছ কাটতে যেয়ে হাত অনেকখানি কেটে ফেললাম।মায়ের সে কি কান্না! তাড়াতাড়ি আঙুল বেঁধে দিয়ে বলল, শুয়ে থাকো সোনা।মা রাগী চোখে আব্বার দিকে তাকিয়ে ঝগড়া শুরু করলো, আমার একরত্তি মেয়েকে দিয়ে কেন মাছ কাটাও? আর কোনোদিনও খুকি মাছ কাটবে না। মা এমন ভাবে কাঁদছে মনে হচ্ছে মায়ের আঙুল কেটেছে।
বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি আসার কয়েকদিন পর তোর বাবা বড়ো ভেটকি মাছ কিনে এনেছে,আম্মা বললেন, বউমা মাছটা কাটো তো। দেখি বাপের বাড়ি থেকে কি শিখে এসেছো?আমি তো আগে অনেক মাছ কেটেছি নির্ভয়ে মাছের পিঠের কাটা কাটতে বটিতে চাপ দিয়েছি হঠাৎ মাছটা হাত পিছলে পড়ে গেল।হাত যেয়ে লাগলো সোজা বটিতে, হাত কেটে রক্ত বের হচ্ছে। আম্মা মুখ কালো করে বললেন, যাও যাও ঘরে যাও ওষুধ লাগিয়ে হাত বেধে ফেলো বাপের বাড়ি থেকে কি কাজ যে শিখেছো বোঝা হয়ে গেছে।
লজ্জায় দুঃখে ঘরে এসে খুব কাঁদলাম। মায়ের কথা খুব মনে হচ্ছিলো মা যদি কাছে থাকতো তাহলে কতো যত্ন করতো। পরম স্নেহে হাতটা বেঁধে দিতো।
মায়ের গল্প শুনছি আর মাছ কাটছি হঠাৎ আমার আঙুল কেটে গেল। আমি আহ্ বলার সাথে সাথে মা ছুটে এসে আমার আঙুল চেপে ধরেছে কয়েক ফোটা রক্ত দেখে মা কান্না শুরু করলো। সেই সাথে বকা, এত বড়ো হয়েছিস সাবধানে কাজ করতে পারিস না? আমারে জ্বালিয়ে শেষ করে দিলি।আল্লাহকে এত বলি যত আঘাত কষ্ট আমাকে দেও আমার সন্তানদের নিরাপদে রাখো তারপরও তোদের বিপদ হয়। মা আমাকে বাচ্চা মেয়েকে যেভাবে বকে সেই ভাবে বকছে।
মা সামান্য হাত কেটেছে তাতেই এত কান্নাকাটির কি হলো সেটাই তো বুঝতে পারছি না!
ও তুই বুঝবি না, যখন মা হবি তখন বুঝবি।
মা জোর করে আমাকে ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেই মাছ কুটে রান্না করলো।আমার বারবার চোখ ভিজে ওঠছে আজ মা’র সামনে হাত কেটেছে তাই কত যত্ন অথচ এর থেকেও কত বেশি কাটাহাত নিয়ে সংসারের কাজ, রান্না সব করেছি।
এখন আমি মা হয়েছি আমার চার বছরের ছেলে তাহমীদ স্কুল থেকে ফিরেছে গালে আঁচড়ের দাগ নিয়ে। তাহমীদের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলাম, মনে হলো কেউ যেন আমার কলিজা ফালাফালা করে দিয়েছে। অটোমেটিক চোখ দিয়ে পানি ঝরছে কাঁদতে কাঁদতে বললাম আব্বু তোমাকে এভাবে আঁচড়ে দিলো কে?
মামণি বিপাশা আছে না আমাদের ক্লাসে ও এমন করেছে। তুমি কাঁদছো কেন? আমি ব্যাথা পেয়েছিলাম সেরে গেছে।
কালকেই বিপাশার আম্মুকে বলব মেয়ের ভালো করে নখ কেটে যেন স্কুলে পাঠায়। কাঁদতে কাঁদতে বললাম পরওয়ারদিগার আমাকে যতো পারো কষ্ট দেও কিন্তু আমার সন্তানকে এতটুকু কষ্ট দিও না।
হঠাৎ মা’র মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠল চমকে উঠলাম মাও তো এই দোয়া করে। পৃথিবীর সব মা-ই একরকম। নিজে সবরকমের আঘাত সহ্য করার জন্য প্রস্তুত কিন্তু সন্তানের গায়ে যেন ফুলের টোকাও না লাগে। মায়ের ভালবাসার সাথে অন্যকারোর ভালবাসার তুলনা হয় না। মায়ের তুলনা শুধুমাত্র মা।
ইসরাত জাহান নিতা- লেখক ও সাহিত্যিক।