○
স্বরুপ নগরের মেয়ে মেহেরজান।তবে ওর আসল নাম মেহেরুন নেছা।বাবা মা ওকে আদর করে মেহেরজান বলে ডাকতো।ছোট বেলা থেকে ওর বড় গুন মাটি দিয়ে হরেক রকমের জিনিস তৈরি করে সবাইকে অবাক করে দিতো।কারন ৫/৬ বছরের এতটুকু মেয়ে কত নিঁখুতভাবে তৈরি করেছে নিজের খেলনাগুলো।বাড়ির সবাই মেহের কে দুষ্টামী করে বলতো তোকে তো কুমার বাড়ির থেকে আমরা এনেছি।এ কথা বলতেই মেয়েটা কান্নাকাটি শুরু করে দিতো।কুমার বাড়িটা ছিল ওদেরই পাশে বাড়ি।মেহেরজান কুমারদের শিল্প কর্ম দেখে নিজেই নিজের জন্য কাঁদা মাটি এনে পুতুল,হাড়ি পাতিল তৈরি করতে শিখে গিয়েছিল।
—–মেহেরের বড়বোন নুরজাহান।ওর বয়স যখন ১২ বছর তখন নুরজাহানের বাবা গ্রাম প্রধানের নির্দেশে বিয়ে দিতে বাধ্য হয়। স্বরুপ নগর গ্রামটায় কুসংস্কার আর ফতোয়াবাজরা নিজেদের কবলে রাখতো।তাদের কথা সবার শুনতে হতো।সাধারন মানুষগুলোর মধ্যে শিক্ষা না থাকায় এরা ওদের দাবিয়ে রাখতো। এ শ্রেনীরা সব সময় এদের কাছে অসহায় ও অবহেলিত ।এরা ফতোয়া দিয়ে অশিক্ষিত মানুষগুলোকে দাবিয়ে রাখতো। মেয়েদের বয়স ১০ বছর হলেই গ্রামের মাওলানারা ফতুয়া দিতে থাকে বিবাহযোগ্য মেয়ে ঘরে রাখা পাপ।শুরু হয়ে গেলো সবার মুখে মুখে মেয়ে বড় গেছে।
—- এ কারনে ওর বাবা মা নুরজাহানকে তারাতারি বিয়ে দিয়ে দিলো ২৫ বছর বয়সী পাত্রের সাথে।
নুরজাহান মনেপ্রানে মেনে নিতে পারিনি এ বিয়েটা। কি আর করবে । জামাই র নাম নুর মুহম্মদ। অনেক নির্যাতনের শিকার নুরজাহান। নুরজাহানের চারটি ছেলে মেয়ে । নুর মুহম্মদ হুজুর প্রকৃতির, তাই নুরজাহান কে কারো সাথে কথা বলতেও দেয় না। এমনকি ওকে ঘর থেকে বের হতে দেয় না।নুরজাহান সাত দেয়ালের মধ্যে বন্দি একটা প্রানহীন প্রানী।এমন কি বাপের বাড়ি পর্যন্ত যেতে দেয় না।
—– এইতো গেলো নুরজাহানের কষ্টের জীবন। এ দিকে মেহের সারাদিন মাটির খেলনাগুলে নিয়ে খেলতে খুব ব্যাস্ত ।এটা নিয়ে ও মাওলানা সাহেবরা বড় বড় ফতুয়া দিতে লাগলো।মেহের ছিল খুবই সুন্দর ও হাসিখুশি একটা মেয়ে। পাশের বাড়ির সেলিম ওকে খুব ভালো বাসতো। কারনটা একটা ছোট একটা বাচ্চা মেয়ে বলে।সেলিম মেহেরেরজানের বাড়ির ওপর দিয়ে যাওয়া আসার সময় মেহেরের রোদে শুকাতো দেয়া দুই একটা পুতুল চুরি করতো।এটা ছিলো মেহের কে ক্ষ্যাপানো।বরাবর মেহেরকে ক্ষ্যাপাতে ওর বেশ মজা লাগতো। মেহেরতো রাগের চোটে খুব বোকাবকি করত।
—– হঠাৎ করে মেহেরের শরিরে কৈশোরের ছাপ দেখা দিলো।সাথে সাথে ঘটকের আনাগোনা শুরু হলো।মেহেরের স্কুলে যাওয়াটাও বন্ধ হয়ে গেলো।এলাকার মহাজনেরা মেহেরের বাবাকে বলতে শুরু করলো এখনই মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে।কারনটা ছিল মেয়েটা বড় হয়ে গেছে।
—–মেহেরের বিয়ের প্রস্তাবের খবর শুনে সেলিম ক্ষ্যাপে যায়।সেলিম দশম শ্রেনীর ছাত্র। সেলিমের প্রতিবাদের কারনে শেষ পর্যন্ত সেলিম কে অনেক কথাও শুনতে হয়।যেহেতু সেলিম এলাকার চেয়ারম্যানের ছেলে হওয়ায় বিষয়টা বেশী গড়াতে পারিনি।
—–মেহেরের চেয়ে দ্বিগুন বয়সী মসজিদের ঈমানের সাথে বিয়ের কথাবার্তা শুরু হয়। বেটার আরো একটা বউ আছে তবুও বিয়ের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হলো।প্রথমে বাবা রাজী না হলেও মহাজনদের নির্দেশে মেয়ে ঈমান সাহেবের সাথে বিয়ে দিতে রাজী হয়ে গেলো।
—– এ দিকে সেলিমের মেহেরের বাড়ির আনাগোনা সেলিমের বাবার একদম অপছন্দের ছিল। তার কথা আমি এলাকার প্রভাবশালী ব্যাক্তি আমার ছেলে একটা চাষার মেয়ের প্রতি আকর্ষন থাকবে কেন?তাই মেহেরকে বিয়ে দিতে মহাজন ওর বাবাকে বাধ্য করে ছিলো।
——তিনি সেলিমকে অনেক বকাবকি করলে সেলিম মনে মনে ঠিক করলো আমাদের এ সমাজ ব্যাবস্থাকে পরিবর্তন করতে হবে।এখন সেলিম ভাবলো আমাকে এ গ্রাম ছাড়তে হবে।মনের সিদ্ধান্ত টা মনের মধ্যে রাখলো। কাউকে প্রকাশ করেনি।
— চেয়ারম্যান সাহেবের নির্দেশে দুই দিনের মধ্যে মেহেরের বিয়ে দেয়া হলো।সেলিমের মনে একটা প্রশ্ন এতটুকু বাচ্চা মেয়ে কে এভাবে বিয়ে দেয়া হলো।সেলিম রাগ করে ঢাকা শহরে চলে যায়। ও প্রতিজ্ঞা করলো এই নোংরা মানসিকতার সমাজে আর থাকবো না।কয়েক মাস খুব কষ্ট করলো বাবার কাছ থেকে কোন টাকাই নেয় নি।প্রথমে বন্ধুর মেসে থেকে পড়াশোনা করতে লাগলো।পাশাপাশি ছোট পত্রিকায় লিখতে শুরু করল।যে সমাজ নারীকে দাবিয়ে রাখে।শিশু বয়সে বিবাহ দিতে বাবা মাকে বাধ্য করা হয়।যে মেয়েটা স্বপ্ন দেখে পুতুল খেলার।সে মেয়েটাকে অাগুনে হাত পুড়ায়ে রান্না করতে হচ্ছে, এটা সেলিমের মনকে বারবার আঘাত করছে।
—–আজ সেলিম সমাজের উপর লিখতে লিখে সারা দেশ ওকে লেখক হিসাবে চিনতে লাগলো।সেলিমের ধারালো কলাম একমাত্র সমাজ পরিবর্তনের অঙ্গীকার। সেলিম এখন একজন সেলিব্রেটি।দেশ জুড়ে নতুন নাম সেলিম মুহতাদী।ওর বই বের হওয়ার সাথে সাথে সব বই বিক্রি হয়ে যায়। সেলিমের নতুন জগত ছিলো সারাদিন পড়াশোনার আর লেখার । ওর কাছে মনে হয় কেবল মাত্র বই হোক সব জ্ঞান অর্জনের একটা অধ্যায়।
—-সেলিমের কয়েক বছর পর মনে হলো গ্রামের কতটুকু পরিবর্তন হলো।কি জানি শুনিছি, কিছুটা হয়েছে। মানুষগুলোর মানসিকতার কতটা পরিবর্তন এসেছে।সুযোগ পেলে একবার যাওয়া দরকার।কেন জানি সেদিন সেলিমের চোখের সামনে ভেসে উঠছে মেহেরের জীবন কাহিনি।।তাই তো মেহের কে দেখতে গিয়ে ও দেখতে পারিনি কারন মেহের এখন কোন পুরুষের সাথে দেখা করে না ।তবে সেদিন মেহের ওর সেলিম ভাইকে আড়াল থেকে দেখে আনন্দিত হয়েছিল।বুকে সেদিন ছিলো চাপা কষ্ট। মেহেরজানের মনে হয়েছিল আমি কি তার লেখার উপকরণ হতে পারি।আমার মত একটা মুর্খ অশিক্ষিত গাইয়াকি কারও লেখার স্থান পেতে পারে।
—– মেহেরজান আজ ও জানেনা সেলিম মুহতাদির উপন্যাসের নায়িকাই স্বরুপ নগরের মেহেরজান।
নেক পারভীন লায়লা (চিত্রা) -লেখক,সাহিত্যিক
—