কয়েক মাস আগের ঘটনা। ছেলের স্কুলে স্টাডি ট্যুর। ওদের স্কুল থেকে বলা হলো আমাকেও সাথে যাওয়ার জন্য, যদি আমার ইচ্ছা থাকে।আমি তো খুব খুশি। সুযোগ হয় না মোটে ঘর থেকে বের হবার।
বেশ ভাল কথা তৈরি হয়ে গিয়ে বাসে উঠতেই সুন্দর একটা বাচ্চা মেয়ে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে আমাকে ওর পাশের সিটটায় বসালো আর বললো, আন্টি আপনি খুব ভালো,আপনি খুব সুন্দর, আপনি আমার কাছেই বসবেন। এটা সেটা অনেক কিছু।
আমি অনেক সময় ধরে ওর বকবকানি শোনার পর ওকে জিজ্ঞাস করলাম তোমার সাথে কে যাচ্ছে? মেয়েটা মুচকি হেসে উত্তর দিল আমি একাই যাচ্ছি।আমি একটু অবাকই হলাম, এই ভেবে এতটুকু বাচ্চা মেয়ে শহরের এই প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত অথচ ওর বাবা-মা ওকে একা ছাড়ল!
ওকে দেখে আমি আমার ছেলে বেলার স্মৃতিতে হারিয়ে গেলাম। কেমন কেটেছে আমার ছেলেবেলা কেমন কেটেছে আমার শিক্ষা জীবন। যখন আমার বয়স পাঁচ বছর,কেবল স্কুলে যাবার সময় হলো তখন আমাকে স্কুলে না দিয়ে বাসায় দু’জন টিচার দেওয়া হলো। একজন আরবী পড়াবেন, আর একজন প্রথম শ্রেণির বই সহ বাকি সব কিছু।
আমার বাসায় পড়তে ভালো লাগতো না স্কুলে যেতে মন চাইতো তাই ঘরে পড়ায় মন বসতো না। পরিবারের সবাই গবেষনা করে বের করলো, এ মেয়ে হয়ত তার বাবার মতো মেধাবী হবে না। লেখাপড়া হবে কিনা আল্লাহই জানে।
আমার মনে আছে আব্বু জখন কলেজে বের হতেন তখন গৃহ বন্দি এই আমি জানলার শিক ধরে, আমার সমবয়সি ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতো তাই চেয়ে চেয়ে দেখতাম। যখন আর একজনকেও দেখা যেতোনা তখন বারান্দায় চলে গিয়ে একা একা স্কুল স্কুল খেলতাম। কিছু সময় আমি যা পারি লিখতাম, আবার কিছু সময় এপাশে রাখা চেয়ারটায় এসে বসে স্যার সাজতাম পড়া নিতাম পড়া দিতাম। এভাবে খেলার ছলে ছলে যখন ক্লাস থ্রিতে উঠলাম তখন স্কুলে দেয়া হলো। আব্বু তখন বরিশালের বি.এম কলেজে। কলেজের কাছেই বাসা আর বাসার কাছেই স্কুল যেখানে আমার ছোট ভাইটাকে দেয়া হলো, আমাকে না। কারন ওখানে ছিল কো-এজুকেশন। আমাকে দেয়া হল বাসা থেকে দূরে হাই ওয়ে পেরড়িয়ে গালস স্কুলে।
আমি কেন আমার ভাইয়ের সাথে স্কুলে যেতে পারিনি কেন আমাকে ঐ স্কুলে দেয়া হলো না এ ব্যাপারটি আজও আমাকে ভাবায়।এ রকম নানা চড়াই উতড়াই পেরিয়ে এস. এস. সি দিলাম। যেদিন রেজাল্ট বেরবে সেদিন কেউ রেজাল্ট আনতে গেলেননা। কারন আব্বু ধরে নিয়েছিল আমি খারাপ করব। এস. এস. সির সময় আব্বু খুব জত্ন করেছেন ঠিকই কিন্তু কোন টিচার দেননি। রেজাল্ট ভালো করলাম। একা একা গিয়ে কলেজে ভর্তি হলাম। রাতে বিছানায় শুয়ে চিন্তা করলাম স্কুল জীবন টা যেভাবেই যাক কলেজ জীবনটা যেন ভাল হয়।
কিন্তু সে আসায় গুরে বালি। সকাল বেলা আম্মু এসে জানালো তোমার আব্বু বলছে, কলেজে ক্লাস করার দরকার নেই আর তোমাকে বিয়ে করতে হবে। পড়বে বিয়ের পর। সেখানে আরেক অভিজ্ঞতা। এ ব্যাপারে আর সামনে এগোলাম না। কয়েক বছর গ্যাপের পর আব্বু মহিলা কলেজের প্রিন্সিপ্যাল হওয়ায় সুযোগ পেলাম এইচ. এস. সি দেয়ার। দিলাম এবং ভালো করলাম। এবার গ্রাজুয়েশনের পালা। ভর্তি হয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।যেহেতু আব্বু প্রিন্সিপ্যাল ফোনে আব্বুর কাছে এইচ এস সির সার্টিফিকেটের কথা বলতেই ওপাশ থেকে ভেংচি কেটে বললেন, ‘সার্টিফিকেট লাগবে এসে নিয়ে যাও’। আামি একটু হলেও কষ্ট পেলাম।
আব্বুর চোখে আমি অত্যন্ত বুদ্ধিমতী এবং বিচক্ষণ মেয়ে। বেশি লেখা পাড়ার কী দরকার।একজন ভাল মা হওয়াও বা কম কিসে?
ঘর সংসার আর বাচ্চাদের সামলিয়ে গ্রাজুয়েশন শেষ করলাম। আব্বু এর মধ্যে একদিন বলছিলেন, “তুমি পড়ালেখা করতে চাও, তাতো কখনও খুলে বলোনি। বললে, আমি ঠিকি পড়াতাম।”যেহেতু কনজারভেটিভ পরিবারের মেয়ে তাই মেনে নিয়েছিলাম তাদের আবদার। কিন্তু ওনাদের আচরনে কোথায় যেন নারী-পুরুষের বৈষম্য ফুটে উঠেছিল। তবে সেটি শুধু শিক্ষার ক্ষেত্রে।
আর এই একটা বৈষম্যই কেরে নিয়েছে আমার জীবন থেকে আমার ছেলেবেলার স্কুল জীবন, মাধ্যমিক আর কলেজ জীবন যা কখনো ফিরে পাবো না।আমি ঘরমুখো জীবনই পছন্দ করি কিন্তু শিক্ষা-দীক্ষা ছাড়া নয়।
সেদিন আমার মেয়ে এসে বললো, আমার এক টিচার তোমাকে স্যালুট জানিয়েছে, তুমি সব সামলিয়ে পড়তে পেরেছো তাই। বিভিন্ন ভাবীরা বলে, ভাবী আপনাকে মেডেল দেওয়া দরকার। কিন্তু এই স্যালুট আর মেডেল আমার চাওয়া ছিল না।আমার চাওয়া ছিল সুন্দর একটা শিক্ষা জীবন। যেখান আমি মুক্ত মনে হেসে -খেলে কাটাতে পারতাম। এসব ভাবতে ভাবতে গন্তব্যে পৌছে গেলাম। আমার ছেলে ও অনান্য বাচ্চাদের সাথে সারাদিন খুব সুন্দর সময় কাটিয়েছিলাম।
মিস করছি সুন্দরিকেও।শাবাস! সুন্দরি। তোমরাই সাজাবে সুন্দর করে আগামীর পৃথিবী। এটাই আমার কাম্য.।
মাহাফুজা শিরিন- কবি, সাহিত্যিক ও মডারেটর চেতনায় সাহিত্য।