আয়োজন করে মরে যাওয়ার চেয়ে নিরবে নিভৃতে বেঁচে থাকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মহসিন সাহেব ফেসবুক লাইভে এসে মহা সমারোহে দীর্ঘক্ষণ ধরে আত্মহত্যার কারণ বর্ণনা পূর্বক লাইসেন্স করা রিভলবার অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় মস্তিষ্কে ঠেকালেন, মৃদু কণ্ঠে কালেমা পাঠ করলেন, চোখ দুটি বন্ধ করলেন এবং তারপর ট্রিগারে চাপ দিলেন। ইজি চেয়ারে বসা শরীর এলিয়ে মাথাটি নির্জীব হয়ে হেলে পড়ে একদিকে। সৃষ্টিকর্তা আত্মহত্যা করার অধিকার দেননি। তবে এই গর্হিত কাজটি কেউ করতে চাইলে সে তা স্বাধীনভাবে করতে পারে। এতে ফলাফল যে ভালো নয়- তাও পরিষ্কার করে ঘোষণা দেয়া আছে।
মহসিন সাহেব নিরবে নিভৃতেই চলে যেতে পারতেন। তার এই আত্মহত্যার পদ্ধতি অনুসরণে অনেকেই উদ্বুদ্ধ হতে পারে। যদি কেউ তাকে অনুসরণ করেই থাকে তবে নিয়মানুযায়ী তিনি সাদকায়ে জারিয়া পাবেন। তার মৃত্যুর পূর্বের কষ্ট গাথা শুনে আমার মতো অনেকেই হয়তো ব্যথিত হয়েছেন। কেউ আত্মহত্যা করলে আমরা সহজেই বলে দিই কাজটি তিনি ঠিক করলেন না। অথচ আমরা কেউ তার ব্যথার ভিতরের স্তরে পৌঁছনোর কথা একটিবারও চিন্তা করি না। কতটা জলরাশি ভর করলে মেঘের মুখ কালিতে কুচকুচে হয় তার হিসেব কে রাখে! কারও আত্মহত্যার খবর পেলেই আমরা তাকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দিই এই দোয়া পড়ে- ‘ফি না-রি জাহান্নামা খ-লিদিনা ফিহা’। কোনো অমুসলিম মারা গেলেও এই দোয়া পাঠ করে নিজের ঈমানকে ধারালো করি। আচ্ছা বলুন তো ইসলাম কি আমাদের এমন নির্মমতা শিখিয়েছে? কাউকে জাহান্নামে পাঠানোর সুপারিশ করতে মুসলমানকে দোয়া শেখানো হয়েছে? অথচ আমাদের পেয়ারা নবীর পাশ দিয়ে যখন ইহুদির লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো তখন তিনি দাঁড়িয়ে সেই লাশের প্রতি সম্মান দেখালেন।
মহসিন সাহেবের ছেলে বউ বিদেশে। কাছের লোকগুলো ব্যবসায়ের কয়েক কোটি টাকা নিয়ে চম্পট দিয়েছে। নির্জন গৃহের কোণে শরীরে বাসা বাধে কর্কট রোগ। রক্তের কণিকায় মাংসের কোষে কোষে ব্যথা। সে ব্যথা বছরের পর বছর ধরে আলোক লতার মতো ছড়িয়ে পড়ে মনের গহীন ভিতর। কেমো থেরাপি ও ডায়ালাইসিসের ঢাল তলোয়ার দিয়ে চলে নিজেরই সাথে নিজের বেঁচে থাকার লড়াই। ডানেবামে সামনে পেছনে চোখ মেলে দেখে- আশেপাশে কেউ নেই সহযোদ্ধা। কারও কানে পৌঁছে না সেনাপতির যুদ্ধ জয়ের ডাক। এক সময় আত্মঘাতী হবার সাধ জাগে মনে। আত্মহত্যাকারী যদি দোজখে যায় তবে তার ক্ষেত্র প্রস্তুতকারীরা কোথায় যাবে? আত্মহত্যাকারীর জন্য দোয়া করা কি মহাপাপ?
সমাজের কীটগুলোর মুর্খতা দেখে আমারও আত্মহত্যা করার কথা মনে হয়েছিলো বহুবার। শুনেছি যমদূত সকল প্রাণির জান কবজের পরে নিজে আত্মহত্যা করবেন। তিনিও কি মহসীন সাহেবের মতো ফেসবুক লাইভে এসে সারা জীবনের কষ্টের কথা বলে পাঁজরের ভিতর হাত ঢুকিয়ে জানটাকে বের করে আনবেন? তারপর ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেবেন বাতাসে? আমার দেখার খুব সাধ জাগে মনে।
রফিকুল্লাহ কালবী- কবি, লেখক ও গবেষক।