রোগটা হয়তো আমার নতুন নয়, অনেক পুরাতন।যতটুকু মনে পড়ে,রোগটা আমার শিশু শৈশব কালেও ছিল।বয়সগত কারণে হয়তো সেই সময়ে এটা রোগ বলে মনে হয়নি।এখন কেন যেন মনে হয়, এটা একটা রোগ,অলস মনের বিলাসী রোগ।জীবনের ডালে পাতায় বহে যাওয়া সরসর শব্দের সুখ আনন্দ, দুঃখ বেদনার, এক অযৌক্তিক আবেগীয় রোগ।এবং রোগটা আমার শরীরে নয়, শরীরের রোগ হলে এক ধরনের শারীরিক যন্ত্রনায় আমাকে ভুগতে হতো, ডাক্তারের কাছে ছুটতে হতো, নানা রকম ঔষুধ খেয়ে যন্ত্রনার উপশমে সচেষ্ট থাকতে হতো।কিন্তু এই রোগটা আমার মনের ভেতরে,মনের গভীরে,জল ছলছল, হৃদয় মৃত্তিকার উঠান বারন্দায় গৃহ মন্দিরে।আর রোগটা খুব একটা ক্ষতিকর বলেও আজ পযর্ন্ত আমার মনে হয় নি।কিন্তু রোগটার নাম কি, তা আমি জানি না।সেই ছোট্টবেলা থেকে আমি এই রোগে আক্রান্ত ছিলাম।তখন আমি বাড়ির পাশে খালে বিলে খাদা খন্দকে বনে জঙ্গলে একা একা ঘুরে বেড়িয়েছি, গাছ পালার সাথে ফিসফাস করে কথা বলেছি, তাদের সুখ দুঃখের সাথী হয়ে মনের আনন্দ বেদনাকে নিজের করে নিতে চেয়েছি।সুরে বেসুরে উচ্চস্বরে গান গেয়ে, সেই সবুজ মাঠ বনকে আমার নিজ হাসি আনন্দের সঙ্গী-সাথী করে নিয়েছি।কখনো কখনো নরম কোমল কালো কাদা মাটি হাতে তুলে নিয়ে সারা শরীরে মুখে মেখে নিয়ে নিজেকে ভুতের মতো সাজিয়েছি।সেই সোঁদা মাটির গন্ধে নিজের ভেতর বাহিরকে রাঙিয়ে নিতেও চেষ্টা করেছি।ভুত সাজলেও, জ্বীন ভুত বা অন্য কোন অপশক্তির খপ্পরে পড়ে আমি যে, এই রকম অস্থির হয়ে ছুটাছুটি করেছি, তাও কিন্তু সত্যি নয়। এসবই ছিল, সেই সময়ে আমার দুঃশ্চিন্তাহীন জীবনের একমাত্র আনন্দ কর্ম।আমার এই ভালো লাগার আনন্দটাকে কেউ হয়তো বুঝতো না, বুঝতেও চাই তো না।শিশু মনের নিছক পাগলামি মনে করে, মুরুব্বিদের অনেকে হেসেছে, কেউ আবার খবরদারীর ছড়ি হাতে নিয়ে তেড়ে এসে আমার পিঠ পাছার উপর দুইচার ঘা বসিয়ে দিয়েছে।আমার এসব অর্থহীন কর্মকাজ দেখে মা চাচীরা আদর করে আমাকে বলতো, আস্ত একটা পাগল।
সেই ছোট্ট বয়সের শিশুটি এখন আমি আর নেই।আমি এখন অবসরে থাকা একজন প্রবীণ।কিন্তু আর্শ্চয্যের বিষয় হলো, সেই শিশু পাগলটা এখনো আমার সঙ্গ ছাড়ে নি।এখনো সে সময় এবং সুযোগ বুঝে আমার সাথে করে নিয়ে পাগলা নাচনে নেচে উঠে।
সেই শিশুকাল থেকে আমার মনে হতো, কেউ একজন আমার ভেতরে বসে আছে, এবং সে একজনটা দেখতে প্রায় আমার নিজেরই মতো,দুরন্ত ছুটন্ত সদা অস্থির।সেও নিজের মনে নিজের মতো করে কথা বলে যায়।কথার ও তার শেষ নেই, কত রংয়ের, ঢংয়ের কথা, বাস্তব অবাস্তব, অসম্ভব অবিশ্বাস্য কথার ফুলঝুরি ছড়াতেও সেই একজনটা বড় বেশি পারঙ্গম পারদর্শি।সেই একজনকে আমি চোখে দেখি না, তবে তার একটা অস্পষ্ট ছায়া ছায়া রুপ আমি অনুভব করতে পারি। চোখ বন্ধ করলে আমি তার অস্থির ছুটাছুটি টা দেখতে পাই, তার ভাব ভাবনাগুলোকে নিয়ে আমিও চিন্তা ভাবনা করি।সরবে নিরবে বলে যাওয়া তার কথাগুলো বুঝতে চেষ্টা করি, এবং সেই মোতাবেক র্কায সম্পাদনেও সচেষ্ট হই।
আমি তার অনুগত থাকলেও সে আমাকে তোড়াই কেয়ার করে।আমার বয়স ব্যক্তিত্ব সামাজিক অবস্থান কোন কিছুকে সে ন্যুনতম সমীহ করে চলে না।একটা অহংকারী দাপুটে ভাব নিয়ে সে তার কাজ করে যায়, আপন মনে অর্নগল কথা বলে যায়, কোন কারণ ছাড়ায় সে আনন্দে নাচে, হাসে, কখনো নিঃশব্দে, কখনো আবার শব্দ করে অট্টহাস্যে, হাসতে হাসতে সে একজন হঠাৎ করে চুপ করে যায়।আবারও কিসব ভাবনায় সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কখনো আবার মুঠোমুঠো রঙিন নুড়ি পাথর আবেগীয় জলে ভিজিয়ে দিয়ে আমার বুকের ভেতর ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়ে যায়।সেই নুড়ি পাথরের ছোট্ট ছোট্ট ধাক্কায় আমার শরীর মনও মুহূর্ত কয়েকের জন্য সেই মার্বেল পাথরের মতো স্থবির হয়ে যাই।
অনুভবে জেগে থাকা সে একজন বয়সে আকৃতিতে আমার চেয়ে অনেক ছোট।কিন্তু মানষিক শক্তি সাহসে বড়ো বেশি দুর্বার।আমি তাকে কিছু বলতেও পারি না,কারণ সে কখনো আমার নিয়ন্ত্রনে থাকে না।সে বড়ো বেশি বেপরোয়া,কোন শৃঙ্খলেই সে আবদ্ধ হতে রাজি নয়।সে চূর্তুদিক চোখ ঘুরিয়ে তার নিজের মতো করে চলে,আমার পছন্দ অপছন্দকে সে তার বিবেচেনায় নেয় না।তার এই বোহিমান স্বভাবের জন্য তার উপর আমার রাগ হয়, কিন্তু তার উপর আমি রাগ ঝাড়তে পারি না।নিজের উপর নিজে রাগ করে বলে উঠি, ধেৎত্তরি, এই কোন পাগলের পাল্লায় পড়লাম আমি।মুখে যা বলি না কেন, এই পাগলটাকে কিন্তু আমি সত্যি সত্যি ভালোবাসি।আমার অস্তি মজ্জায় রক্তের প্রতিটি দানা কনায় এই পাগলের লাফ ঝাঁপ আর প্রলাপকে অনুভব করি। নিজেও আমি তখন তার স্বর-শব্দ নকল করে আপন মনে শব্দে নিঃশব্দে প্রলাপ বকতে শুরু করি।এই পড়ন্ত বয়সে তার এই পাগলামিটা আমাকে সঞ্জীবিনী সুরার মতো উপভোগ করি।
হাসনাত হারুন- কবি, সাহিত্যিক ও গবেষক।