বাঙলা সংস্কৃতি আমরা যারা ধারণ করি মনে মননে তারা রবি ঠাকুরের কাছে কৃতজ্ঞ আজন্মকাল। একজন বাঙালির জীবনে রবি ঠাকুর অতোপ্রতভাবে মিশে আছেন প্রতিটি আবেগে,প্রতিটি অনুভূতিতে।
“এসো নিপবনে ছায়াবীথি তলে,এসো কর স্নান নবধারা জলে,এসো নিপবনে… ”
এই গানটি শুনলে আমাদের মনে এক অপার্থিব আনন্দ খেলা করে। বর্ষার নবধারায় স্নাত হতে চায় না, এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া দূর্লভ।
“দাও আকুলিয়া ঘন কালো কেশ
পরো দেহ ঘেরি মেঘ নীল বেশ
কাজল নয়নে যূথী মালা গলে
এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে।”
লাইনগুলো লক্ষ করুন। মেঘনীল বেশ পরে বৃষ্টি ধারায় আমন্ত্রন জানানো হচ্ছে । এ যেনো প্রেমিক রবি বৃষ্টির মাঝে নীপবনে পরম প্রিয়ার জন্য আজন্ম অপেক্ষা করছেন।কুমারি মন এমন আহবানের প্রতিক্ষায় কাটে কতশত বিনিদ্র শ্রাবণ রাত। সকল বাধা, সকল দিধা উপেক্ষা করে ছুটে যাই রবির নীপবনে। এখানেই প্রেমিক রবি সার্থক হয়ে যুগে যুগে ফিরে অাসেন প্রেমিকার মনে। বর্ষার বৃষ্টি ভালোবাসে অার রবির এসো নীপবনে গানটি গুনগুন করেনি এমন বাঙালি পৃথিবীর কোথাও অাছে বলে মনে হয় না।
এতো গেলো বর্ষায় রবি বন্দনা।
“অামারও পরানে যাহা চায় তুমি তাই, তুমি তাই গো..”,
কিংবা
“”ভালোবাসি,ভালোবাসি সেই সুরে জলে স্থলে বাজায় বাশি, ভালোবসি””
প্রেমিকের প্রতি একজন প্রেমিকার আত্ন নিবেদন এই গান গুলোয় ফুটে ওঠে।
“তুমি সুখও যদি নাহি পাও, যাও সুখেরও সন্ধানে যাও…”
এই লাইন যখন শুনি আমার চোখ ভিজে যায় কোন এক পরম ভালো লাগায়।একজন প্রেমিক বা প্রেমিকা কতটা ভালো বাসলে তার প্রিয় জন কে এতটা স্বাধিনতা দিতে পারে।কতটা উদার হলে বলতে পারে সুখের সন্ধান তাকে যেতে। কতটা আত্নবিশ্বাস থাকলে বলা যায় “আমি তোমারে পেয়েছি জীবন মাঝে, আরও কিছু নাহি চাই গো।”প্রেম শুধু ধরেই রাখে না।প্রেম মুক্তি ও দিতে পারে।
এখানেই রবি প্রেমের মহত্ত্ব দেখিয়েছেন।প্রেমের সৌন্দর্য শিখিয়েছেন।
“দিবস রজনী আমি যেনো কার, আশায় আশায় থাকি।”
সত্যি তো দিবস রজনী আমি তার আশায় আশায় থাকি।৷সেই মানুষ টি কখনও রবি হয়ে, কখনও তিনি হয়ে আমার সামনে আসে। এই যে শত বছর পরেও রবির সাথে আমার অনুভূতি মিলে যায় এটাই তো একজন কবির, একজন রচয়িতার সার্থকতা।
“ক্ষণিক আলোকে আঁখির পলকে তোমায় যবে পাই দেখিতে
হারাই হারাই সদা হয় ভয়,হারাইয়া ফেলি চকিতে।”
প্রেমিককে বা প্রেমিকাকে হারানোর ভয়ে ভীত আমরা সবাই। এই বুঝি সে অন্য কারও হয়ে যাচ্ছে এই ভয়ে ভীত আমি,আপনি, সে।
“আর কার ও পানে চাহিব না আর, করিব হে আমিপ্রানপণ…
তুমি যদি বল এখনি করিব বিষয়বাসনা বিসর্জন।।”
সকল কিছু বিসর্জন দিয়ে হলেও তার ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার তীব্র আকাঙখা ঘুরে ফিরে এসেছে যুগের পর যুগ সকল ভালোবাসার মানুষের মনের আকুতি রুপে। ভালোবাসার মানুষ কে পাবার জন্য, তাকে সুখি করার জন্য প্রানপণ আমাদের চেষ্টা চলে। তার পায়ে সকল পুজার ফুল নিবেদন করে তারই প্রতীক্ষায়, তারই কৃপা পাবার বাসনায় মনের মন্দিরে নতুন পূজার আয়োজন করি।
রবি ঠাকুর আমাদের শিখিয়েছেন ভালোবাসার গভীরতা, আবার ভালোবাসাকে মুক্ত করে দেবার মত সাহস, উদারতাও মহিয়ান করে তোলে এ বিষয় টাও তার মাঝে আমরা খুজে পাই।
আজ রবি ঠাকুরের প্রয়ান দিবস। আজ ২২ শে শ্রাবণ। রবি ঠাকুর আমার প্রথম প্রেম। প্রথম লুকিয়ে চোখ মুছে নেবার সারথ সঙ্গী। সকাল থেকেই শ্রাবন তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।যাকে হারিয়েছি তাকে আর পাবো এমন সম্ভবনা নেই জানি।কিন্তু তিনি যা দিয়ে গেছেন তা হারিয়ে ফেলার মত বোকা হয়তো আমি নই।কবিগুরুর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা। সকল আবেগ আপনার ছায়ায় পরিপূর্নতা পায়।একজন রবি প্রেমিকা হয়ে এটাই আমার বড় প্রাপ্তি জানি।
শেষে আমার খুব পছন্দের রবি ঠাকুরের কয়টা লাইন দিয়ে শেষ করছি।
“”অনেক দিনের অনেক কথা,ব্যাকুলতা,বাধা
বেদন- ডোরে,
মনের মাঝে উঠেছে আজ ভ’রে।
যখন পূজার হোমানলে উঠবে জ্বলে একে একে
তারা,
আকাশ- পানে ছুটবে বাধন-হারা,
অস্তরবির ছবির সাথে মিলবে আয়োজন
আমার ব্যথার পূজা হবে সমাপন।।””
সেলিনা রহমান শেলী –
কবি ও সাহিত্যিক