“আমাকে খোঁজ না তুমি বহুদিন
কতদিন আমিও তোমাকে
খুঁজি নাকো; এক নক্ষত্রের নিচে তবু-
একই আলো পৃথিবীর পারে
আমরা দুজনে আছি;
পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
প্রেম ধীরে মুছে যায়,নক্ষত্রেরও একদিন
যেতে হয়…”
খুব আনমনে শত শত বার নিজেকে শোনানো কবিতা গুলোর মধ্য এই লাইনগুলো আমার খুব বেশি রকমের আপন।আমরা বাংলা সাহিত্য প্রেমিরা খুব বেশি রকমের ভাগ্য নিয়ে এই বাংলায় জন্মেছি।আমাদের একজন জীবনানন্দ দাশ রয়েছেন।
তার কবিতা আমাদের প্রকৃতির কাছে নিয়ে যায়।তার লেখায় আমরা কার্তিকের নবান্নের গ্রাণ পাই।তার কবিতায় আমরা বাংলাকে ভালোবেসে হাজার জন্ম ফিরে ফিরে আসতে চাই।
প্রকৃতিকে যে কত রুপে কত ভাবে কবিতায় উপস্থাপন করা যায় তা হয়তো জীবনানন্দের মত এত নিখুঁত ভাবে অন্য কেউ তুলে ধরতে পারেন নাই।এজন্যই হয়তো তাকে নির্জনতার কবিও বলা হয়।
জীবনানন্দ দাশের প্রেমের কবিতা আমাকে অন্য এক আবেগের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।
“তবু তোমাকে ভালোবেসে
মুহূর্তের মধ্যে ফিরে এসে
বুঝেছি অকূলে জেগে রয়
ঘড়ির সময়ে আর মহাকালে
যেখানেই রাখি এ হৃদয়”
আহা, ঘড়ির সময় থেকে মহাকালের সাথে প্রেমিকাকে ভালোবাসার যে গভীরতা তিনি তুলে ধরেছেন তা সকল প্রেমিক মনের অব্যক্ত অনুভূতির প্রকাশ।
কখনও তিনি প্রেমিকাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন,
“সুরঞ্জনা,ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি,
বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে,
ফিরে এসো সুরঞ্জনা:
নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে,”
প্রেমিকাকে শুধু নিজের করে রাখতে কি আকুল আহ্বান। সুরঞ্জনাকে অনুরোধের বাঁধনে কবির আবেগি মন বাঁধতে চেয়েছে। প্রেমিক বা প্রেমিকাকে অন্য কারও সাথে ভাগ করতে আমরা পারি না। এটাই প্রেমের ধর্ম।
বনলতা সেনকে নিয়ে জীবনানন্দ দাশের অসাধারন এবং অসাধারন কবিতা পড়ে নাই বা আবৃত্তি শুনে নাই এমন পাঠক বা সাহিত্যমনা মানুষ পাওয়া প্রায় অসম্ভব।
আমি নাটোরের মেয়ে বলেই হয়তো এই কবিতার প্রতি আলাদা এক আবেগ, এক ভালোলাগা কাজ করে।
হাজার বছরের পথ চলায় ক্লান্ত কবির সকল ক্লান্তি দূর হয়ে যায় বনলতার দেখা পেয়ে।মনের সকল ভালোবাসা দিয়ে কবি বনলতাকে একেঁছেন অন্ধকার বিদিশার নিশা লাগানো চুলের মাদকতায়।প্রিয়ার চোখের সাথে দারুচিনি দ্বীপের সবুজ ঘাসের স্নিগ্ধতার মিল খুঁজে পান।চির কাঙখিত প্রেমিক মানুষকে দেখে আমরা আবেগে অভিমানে জানতে চাই,
“এত দিন কোথায় ছিলেন?”
এই একটি লাইনে প্রেমিকার প্রতি যে অজস্র ক্ষনের আবেগি অপেক্ষার বহি:প্রকাশ ঘটেছে। আমার ক্ষুদ্র পাঠক জীবনে এত অল্প কয়টি শব্দে অপেক্ষার গভীরতা বোঝানোর উদাহরণ আর আছে কি না আমার জানা নেই।
ভালোবাসার কবিকে নিয়ে লিখতে গেলে কখনই লেখা শেষ করা সম্ভব নয়।
আজ আমার,আপনার সকলের প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশের জন্মদিন।
এই ক্ষণজন্মা কবিতার রাজপুত্রের প্রতি রইল আমার অন্তরের ভালোবাসা।
“আপনি আমাদের মনের সাথে মিশে আছেন প্রিয় কবি।আপনাকে অনেক শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা। যুগে যুগে ফিরে আসেন বাংলায় আমাদের ভালোবাসা হয়ে।আমাদের ভালোবাসায় আপনি আছেন, থাকবেন।”
কবির বনলতা সেন কবিতার কয়টি লাইন দিয়ে শেষ করছি..
“পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল,
সব পাখি ঘরে আসে- সব নদী- ফুরায় এ- জীবনের
সব লেনদেন,
থাকে শুধু অন্ধকার,মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।”
সেলিনা রহমান শেলী- কবি ও সাহিত্যিক।