Take a fresh look at your lifestyle.

চিঠি

46

 

 

প্রিয় নয়া,
শুভেচ্ছা নিও ৷ ঠাকুমা অর্থাৎ দাদী ও মাসির প্রতি রইল নমস্কার ৷ আর মিস্টি মেয়ে নাসরিনের প্রতি রইল প্রাণ ঢালা আদর ৷ জানি চিঠি পড়ে অবাক হচ্ছ ৷ অবাক হবারই কথা,নমস্কার কেন দিলাম ৷ দাদীর অনুমান সঠিক ছিল ৷ আমি মুসলমান নই খ্রীষ্টানও নই,খাঁটি হিন্দু ব্রাক্ষ্মনের মেয়ে ৷ ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার আগেই আমার আশীর্বাদ হয়ে গেছিল ৷ আমার হবু বর একজন শিল্পপতি ৷ অনেক বড় মনের মানুষ ৷ তিনি চেয়েছিলেন আমি যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করি ৷ আমার মনেও আত্মবিশ্বাস ছিল ৷
ভর্তি পরীক্ষায় ভালই করছিলাম ৷ কিন্তু কি যেন হয়ে গেল ৷ কুলে এসে ঠিক তরী ভিড়ছিল না ৷ ব্যর্থ হলাম ৷ মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল ৷ তাহলে কি স্বপ্নের
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া হবেনা ? এই চরম বিপদে তুমি ত্রাণকর্তা হয়ে আবির্ভূত হলে ৷ আমি উতরে গেলাম ৷
তোমার কাছে বিষয়টি ছোট হলেও আমার জীবনে
এটি অনেক বড় ঘটনা ৷ তখন থেকে পরিবারের সবায় তোমার কাছে চির কৃতজ্ঞপাশে আবদ্ধ ৷ আমার হবু বর তোমাকে অনেক টাকা দিতে চেয়েছিল,আমি নিইনি ৷ কারন তোমাকে আমি ছোট হতে দেবনা ৷ তোমার অলক্ষ্যে তোমাকেই তারা খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছে ৷ আমি তোমাকে বলিনি ৷ তোমার মত নির্ভরযোগ্য ছেলে নাকি লাখেও পাওয়া যায় না ৷ তাই কথা ছিল শিক্ষাজীবন যেন তোমার পাশে থেকে শেষ করি ৷ এটা অন্য কিছু নয় কৃতজ্ঞতার বহিঃ প্রকাশ৷
মজার ব্যাপার হল তোমাকে খরচ করতে না দিয়ে আমি নিজেই মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করতাম ৷ ভাবতে আমি বড় লোক ৷ আগেই বলেছি হবু বর অনেক অর্থবিত্তের মালিক ৷ সেই যোগান দিত খরচের টাকা ৷ তুমি কখনই কোন কিছু জানতে চাওনি তাই আমিও সত্য প্রকাশ করিনি ৷
জীবন বড়ই অদ্ভূত ৷ চলার গতি পথ সে নিজেই ঠিক করে নেয় ৷ ভর্তি পরীক্ষায় মর্মে মর্মে সেটা অনুভব করেছিলাম ৷ সেদিন যদি ত্রাণকর্তা হয়ে আবির্ভূত না হতে তাহলে হয়ত আজকের এই চিঠির জন্ম হ,ত না ৷ তুমি এত সরল কেন গো ! কেন সেদিন অপরিচিতের মত আমাকে ফিরিয়ে দিলে না ! সবই বোধ হয় নিয়তি ৷ নিয়তিই সেদিন দুজনকে এক সুঁতোয় বেঁধেছিল ৷ আর প্রকৃতি দু,বাহু বাড়িয়ে ক্রমে ক্রমে সেই বন্ধনের উপর ভালোবাসার রং চড়িয়ে হৃদ্য করেছে ৷ তুমি যে একটা ভীতুর ডিম তা তোমার মেয়ে মানুষ এড়িয়ে চলার আচরণে বুঝতে পেরেছিলাম ৷ ভেবেছিলাম আমার ক্ষেত্রেও বুঝি তাই হবে ৷ কিন্তু আশ্চর্য্যের ব্যাপার তুমি তা করলে না ৷ প্রথম চেনাতে গ্রহন করে নিলে ৷ আমারও মন
কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল ৷ এরপর বন্ধুত্বের সোপানে চড়ে শুধুই দু,জনের এগিয়ে চলা ৷ আর কোন বাধা রইল না ৷ বিনোদপুর, কাজলা গেট অক্ট্রয়ের মোড়
তালাইমারি কোন কিছুই আমাদের পদ চিহ্নের বাইরে নয় ৷ কালক্রমে দু,জনের পথ চলা যেন নেশায় পেয়ে বসল ৷ একা নিঃসঙ্গ সময় পাড়ি দেয়া যেন অসম্ভব হয়ে উঠল ৷ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয়
লাইব্রেরী তার স্বাক্ষী ৷ তুমি ঘন্টার পর ঘন্টা বইয়ের
মধ্যে ডুবে থাকতে নোট তৈরী করতে ৷ আমি পাশে বসে তোমার একাকিত্ব দূর করতাম ৷ ইচ্ছে হলে এক আধটু নোটও লিখতাম ৷ কিন্তু তোমার নোটে ছিল সীমাহীন আস্থা ৷ স্বার্থপরের মত তোমার ঐসব
পরিশ্রমের ভান্ডারে ভাগ বসাতাম ৷ অথচ বিনিময়ে
কিছু চওনি ৷ এনিয়ে কখনো অনুযোগও করনি ৷ এটা
কি শুধুই কর্তব্যবোধ ? কিসের কর্তব্য ! কই,কখনো মুখ ফুটে তো কিছু বলনি ৷ তবে কি এটা নিঃশব্দ
ভালোবাসা ? একদিন দুপুরে সিএন্ডবি,র রাস্তা ধরে
আমরা হাঁটছিলাম ৷ উদ্দেশ্য ছিল বাঁধের ওপারে পদ্মা তীরের আম্রকাননে সংগোপনে সময় কাটানো ৷ কিন্তু জনমানবহীন নির্জন রাস্তার পাশে
কৃ ষ্ণচূড়ার গাছ দেখে অবাক হলাম ৷ ফুল গুলো লাল পাঁপড়ি মেলে এমন ভাবে ফুটে আছে যেন
ঝাঁকরা মাথায় লাল টোপর পরেছে ৷ কি অপূর্ব দৃশ্য !
চারপাশ যেন রক্ত রাঙা ৷ আমি আবেগ প্রবণ হয়ে উঠলাম ৷ তোমার হাত ধরে কাছে টানতে তুমি থর
থর করে কেঁপে উঠলে ৷ সে সময় তোমার মুখ খানা
যা সুন্দর লাগছিল যেন কৃষ্ণচূড়া ফুলের পাঁপড়ি ৷
সেদিন প্রথম অনুভব করলাম ছেলেদেরও লজ্জার
কমতি নেই ৷ আরো একবার অবাক হয়েছিলাম ৷
সেদিন তোমায় বুঝতে পারিনি ৷ আমরা বালুচরের বুকের উপর দিয়ে পায়ে হেঁটে নদীর কিনারে এসে দাড়ালাম ৷ শান্ত স্নিগ্ধ পদ্মা ছোট ছোটো ঢেউ তুলে
কুল কুল শব্দে বয়ে চলেছে ৷ সূর্য্য প্রতি দিনের মত
পশ্চিম দিগন্তে হারিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে ৷
কয়েকটি ছোট ছোট মাছ ধরা নৌকা ছলাৎ ছলাৎ

শব্দে বাড়ির পথ ধরেছে ৷ সূর্য্য ডুবে যাওয়ার পরও
শেষ আলোটুকু আকাশে রং ছড়িয়ে আলো আঁধারির মায়া ছড়াচ্ছে ৷ তোমাকে সেদিন কেন যেন ম্রীয়মান দেখাচ্ছিল ৷ তুমি যে গান জানতে তা
আগে কখনো জানিনি ৷ তোমার কন্ঠে ছিল পেশাদার শিল্পীর সুর ৷ হঠাৎ বিরহের গান ধরলে ৷
অবাক হলাম ৷এগান কেন গাইলে ? কিসের দূঃখ
তোমার ? তবে কি সেদিন আমিই উপলক্ষ্য ছিলাম !
খুব অচেনা লাগছিল তোমাকে ৷ আমাকে নিয়েই যে
তোমার সকল দূঃখ গাঁথা আমি দূর্মতি তার কিছুই
বুঝতে পারিনি ৷ তুমি যে আমায় কত ভালোবাস ,
তোমার ভালোবাসা যে সমুদ্রের তলদেশের চেয়েও
গভীর সেটা মূহূর্তকাল দেরিতে হলেও হৃদয় দিয়ে
অনুভব করেছিলাম ৷ কিন্তু আমার হৃদয় তো তোমার মত উদার আকাশ নয় ৷ সেখানে আশীর্বাদ
বল আর বাগদানই বল ঐ নামের জগদ্দল পাথর
আমার হৃদয়ের দরজাকে সংকীর্ণ করে দিয়েছে ৷
তাই বলে আমায় হৃদয়হীন ভেবনা ৷ সুতীব্র ব্যথায়
আমার হৃদয় যে বার বার ক্ষত বিক্ষত হয়ে উঠে তা
ঐ আশীর্বাদ নামের রক্ত চক্ষুর কারনে ৷ তোমায় সে
কথা কখনো বলতে পারিনি ৷ বন্ধু,জীবনটা কি এমন হতে পারতনা; তুমি শ্রাবণের মেঘ হয়ে বৃষ্টি হয়ে ঝরলে আর আমি তাতে মন প্রান সঁপে অবগাহন করলাম ৷কিন্তু তাতো হবার নয় ৷ জীবন এমনই;নিয়তির হাত ধরে চলে ৷ আমার আর কিছু বলার নেই ৷
চিঠি দীর্ঘ করব না তোমার বিরক্তির কারন হতে পারে ৷ আর একটি কথা যা না বললে
আমৃত্যু মনের গ্লানি নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে ৷ দোল
পূর্ণিমার তিন দিনের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি যাব বলে
মনস্থ করলাম ৷ তুমি আঁৎকে উঠলে ৷আমি জানতাম আমার সামান্যতম অনুপস্থিতি তোমার মনকে ভেঙ্গে চৌচির করবে ৷ তাই এই বেশে আর
কখনো ফিরে আসবোনা জেনেও ফিরে আসার মিথ্যে আশ্বাস দিয়েছিলাম ৷ আমার কিছু করার ছিলনা ৷ ধর্মের অনুশাসন আমাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে
রেখেছে ৷ সেই অনুশাসন ভেঙ্গে কাছে যাওয়ার সাহস আমার কোথায় !
বন্ধু কষ্ট পাবে জানি তবু কষ্ট নিওনা ৷
আমার বিয়ে হয়ে গেছে ৷ আমি সাত পাঁকে বাঁধা
পড়ে গেছি ৷ জন্ম জন্মান্তরের বন্ধন ৷ এ বন্ধন ছেঁড়ার নয় ৷ তারপরেও এত কষ্ট লাগছে কেন ? তুমি ত আমার শুধুই বন্ধু ছিলে ৷ তাহলে বুকের মধ্যে এত হাহাকার কেন ?কেন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে ! তবে কি আমার হৃদয়ে তোমার জন্য ভালোবাসার জন্ম দিয়েছে ? তাতে
কি লাভ ? দোলযাত্রার বসন্ত উৎসবে আবিরের রংয়ে রাঙিয়ে দিতে তুমি ত কখনো শ্যাম হয়ে আসবেনা ৷ তোমার আমার মধ্যে যোজন যোজন
দূরত্ব ৷ তোমার আমার মাঝখানে ধর্ম রুদ্রমূর্তি হয়ে
দাড়িয়ে আছে ৷ সে কখনোই আমাদের এক হতে
দেবে না ৷ সে ভালোবাসা বোঝে না নীতি বোঝে ৷
বন্ধু নীতির বলি হয়ে ক্যাম্পাসে যখন ফিরে আসব
তখন হয়ত আমি অন্য উপমা ৷ পারবে কি সেই উপমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে ? তোমার জন্য হাত দু,খানি প্রসারিত করে রাখলাম ৷ ৷

ইতি

তোমার হতভাগিনী

উপমা

ডিঙ্গাডোবা
রাজশাহী ৷

( চিঠিটি নয়া উপমা গল্পের শেষাংশ ৷ )

———–শেখ তৈমুর আলম——-

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.