বইয়ের নাম: পুতুলনাচের ইতিকথা
লেখক: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
ধরন: উপন্যাস
প্রচ্ছদ: মাহবুব কামরান
প্রকাশক: স্বত্ব
মূল্য: ২০০/-
পৃষ্ঠা: ২০৮
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এক অনন্য নাম। সাহিত্যের বাস্তব রূপ বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে তাঁর লিখনীর মাঝে প্রকাশ করেছেন।
পুতুল নাচের ইতিকথা এমনই একটি উপন্যাস।
সমাজ জীবনের চরম বাস্তবতা ফুটে উঠেছে এ উপন্যাসের ভাঁজে ভাঁজে।
গাওদিয়া গ্রামের হারু তার মেয়ে মতির বর দেখে বাড়ি ফেরার পথে বর্জ্রপাতে মৃত্যু হয়।
তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় এ মৃত্যু বেশ রহস্যময়।
তখন সমাজ জীবনের পরতে পরতে কুসংস্কার ছড়িয়ে ছিল।
হারুর ছেলে পরান, পরানের স্ত্রী কুসুম।
আর অবিবাহিত মেয়ে মতি।
অপরদিকে গ্রামের প্রভাবশালী মানুষ গোপাল।
সুদিকারবার, বলপ্রয়োগকারী, রাগী, জেদি গোপাল যাইচ্ছে করে বেড়ান।
গোপালের এক মেয়ে বিন্দু মাসী, এক ছেলে শশী।
শশী এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র।
কলিকাতা থেকে ডাক্তারী শেষ করে গাওদিয়া গ্রামে এসেছে।
কুসংস্কার বিরোধী, উচ্চশিক্ষিত, বিনয়ী, মার্জিত স্বভাবের ছেলে শশী।
গ্রামে আসার দিনই মাঝ পথে হারুর মৃত দেহ দেখেছিল সে।
মতি মনে মনে শশীকে পছন্দ করতো, এমন সুঠাম সুন্দর মানুষের প্রেমে পড়া দোষের কিছু নয় কিন্তু মতি নিজের ভালো লাগা আর পছন্দ নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল।
শশীও মতির মায়া জালে পড়েছিল
এমন সুন্দরী বোদ্ধা মেয়ে খুব কমই হয়।
মতির সাথে শশীর জীবন দর্শন মিল থাকার পরও তাদের বিয়ে হয়নি।
আত্নীক টান দুজনের ছিলো তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
পরান বোনের বিয়ে ভালো পরিবারে দিতে চাই তার রুচিসম্মত বোন জামাই চাই তারই প্রমাণ হয় এ উপন্যাসের মধ্যে।
কুসুম পরানের স্ত্রী, মধ্যবয়সী বন্ধা মহিলা। কুসুমের শারীরিক গঠন যুবক মানুষের জন্য লোভনীয় বৈকি।
নিজের ইচ্ছে আর ভালো লাগার কথা শশীর কাছে বারবার বলতে চেষ্টা করেছে।
কুসুম বলেছে ডাক্তার বাবু আপনার কাছে আসলে আমার শরীরের মধ্যে কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠে।
কিন্তু শশীর দৃষ্টি ঘুরাতে পারেনি কুসুম।
শশী বলেছিল, শরীর! শরীরই কি সব কুসুম মনের প্রেম নেই।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ঐ সময়ও সাহিত্যের রুচিবোধ সুচারু রূপে উপস্থাপন করেছেন।
তুলে ধরেছেন সমাজের স্ব চিত্র।
একসময় কুসুম রোগা পরানের ঘর ছেড়ে চলে যায় কলকাতায়।
এরপর শশীর চারপাশ যেন ফাঁকা হয়ে যায়।
মানুষের সামনে যা থাকে তার গুরুত্ব সময় মতো থাকেনা কিন্তু তার অনুপস্থিতি হৃদয় মিসমার করে দেয়।
শশী ভালো ও বড় ডাক্তার হবার পরেও সামাজিক কুসংস্কার ভাঙতে তার কষ্ট হয়।
শশীর বন্ধু কুমুদ আসে যাত্রা গানের নায়ক হয়ে – সময়ের সাথে মিশে যায় কুমুদ মতির সাথে।
বাস্তবতা মতিকে কুমুদের বউ বানিয়ে দেয়।
পাটের বড় মহাজন নন্দলাল। অর্থ – সম্পদের মালিক আর কিছুটা ভোগ বিলাসী হবার দরুন গোপাল নিজের মেয়ে বিন্দুমাসীকে একরকম জোর করে তার সাথে বিবাহ দেন।
নন্দলালের আরেক স্ত্রী সন্তান থাকার পরও তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিন্দু মাসীকে বিয়ের পরিণতি খুব ভালো হয়েছিল তা নয়।
নন্দলাল – বিন্দু মাসীকে ভিন্ন মহলে রক্ষিতা করে রেখেছিল।
ঐ বাড়িতে চলে নানা অপকর্ম।
একপর্যায়ে নন্দলালের সঙ্গে সঙ্গে বিন্দু মদপানে অভ্যস্থ হয়ে পড়ে।
শশী বাবার হটকারিতায় নিজের বোনের বেহাল দশা থেকে মুক্ত করে আনতে চেয়েছিল।
বিন্দু শশীর কাছে এসেও মদ ছাড়তে পারেনি।
নন্দলালের প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর বিন্দুর প্রতি নির্যাতন কমেছিল।
এক সময় নন্দলাল ও বিন্দুর সম্পর্ক ভালো হয়ে ছিল।
শশীর মনপ্রেম, ইচ্ছে অনুভব, উপলব্ধি, অনুভূতি আটকা পড়েছিল সেই সমাজ ব্যবস্থা- কুসংস্কারের কাছে।
কবিরাজ, গনক, অশিক্ষা, সামাজিক অবক্ষয়ের সাথে প্রতি মুহুর্তে যুদ্ধ করতে হয়েছে শশীকে।
একাধিকবার কলকাতা যেতে চেয়েও সামাজিক দায়বদ্ধতা তাকে টেনে ধরেছিল।
পুতুল নাচ একটি রঙ্গ মঞ্চ।
মঞ্চে পুতুলের নাচ দেখা যায়, অভিনয় দেখা যায়,এক একটা কাহিনির আগমন ঘটে কিন্তু যে এ পুতুল গুলো নাচায় সে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায়।
মানব জীবনের চাওয়া পাওয়া আর অসংগতির এ কথাগুলো উপন্যাসের মধ্যে সাবলীল ভাবে উপস্থাপন করেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।
আব্দুল মতিন – সম্পাদক, চেতনা বিডি ডটকম।