গ্রন্থ পর্যালোচনা
পুস্তকের নাম – ডাকঘর
রচনা- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শিশুকালেই ডাকঘর নাটকের সাথে আমার পরিচয়। স্কুলের মঞ্চে অভিনয় দেখেছি, বেতার নাটকে শুনেছি সবচেয়ে বেশি বিভোর হয়ে শুনতাম বহুরূপীর প্রযোজনায় শম্ভু মিত্রের শ্রুতিনাটক ডাকঘর। অমলের চরিত্রে তখনকার শিশুশিল্পী চৈতালী ঘোষালের অনবদ্য অভিনয়। তখন একতরফা মনে মনে খুব একচোট ঝগড়া করতাম রবিঠাকুরের সাথে। বলতাম, কেন তুমি অমলের ঘুম ভাঙিয়ে দিলে না, রাজকবিরাজ তো এসেছিলেন। রাজাও আসবেন। তবে অমল কেন অমন করে ঘুমিয়ে থাকবে? রবিঠাকুর, এটা তোমার খুব অন্যায়, একদম ঠিক হয়নি।
তারপর ক্রমে বয়স বেড়েছে। ডাকঘর তখন অন্যমাত্রায় হাজির হয়েছে আমার সামনে। একসময় একটা ইংরিজি মাধ্যম ইস্কুলে পার্টটাইম শিক্ষকতা করতাম। ছাত্র ছাত্রীদের ফিজিক্স আর ম্যাথমেটিক্স পড়াতাম। বছর শেষে ওরা একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতো। ইংরিজি মাধ্যম ছাত্র ছাত্রীদের বাংলার প্রতি একটা অনীহা থাকে। কিন্তু সেবার যখন ওদের কাছে ডাকঘর নাটকের প্রস্তাবনা রাখা হলো, ওরা সবাই খুশিমনে এগিয়ে এলো। নাটকটি উপস্থাপন করার সময় বলেছিলাম,
“আমাদের পরবর্তী অনুষ্ঠান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটক “ডাকঘর”। যে বেদনাবিধুর নাটক তীক্ষ্ণ শলার মতো বুকে বিঁধে আমাদের আবেগ অনুভূতির দরজায় গভীরভাবে নাড়া দেয় ডাকঘর তেমনই এক নাটক। স্কুলের শিক্ষার্থীরা এই নাটকের পাত্রপাত্রীদের বাস্তবরূপে দর্শকদের সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করবে।
অমল নামের একটি শিশুহৃদয় যখন কবিরাজের কঠোর ব্যবস্থাধীনে রুদ্ধ কারায় বদ্ধ থেকে খোলা স্বাধীন আকাশের নিচে বেরিয়ে আসার জন্যে আকুল হয়েছিলো তখন তার সেই আকুতি পরিত্রাণকর্তার কানে পৌঁছায়নি। ফলে তাকে বরণ করতে হয়েছিল কঠিন নিদ্রা। একদিন তার ডাক যখন রাজার কাছে গিয়ে পৌঁছালো, তখন তিনি সবরকম সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তখন কি শিশু অমল ঘুমের দেশ পেরিয়ে দুর্গম পাহাড় জঙ্গলের কঠিন বাধা পার হয়ে অসীমকে জানার ব্যাকুল ইচ্ছে পূরণ করতে পেরেছিলো? এই নাটকে আমরা সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো।
ডাকঘর রচনার পূর্বেকার দশবছরের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের জীবনে নেমে এসেছিলো চরম এক দুঃখের দিন–পুত্র শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু। সম্ভবতঃ এই নাটকে তার প্রতিফলন ঘটায় নাটকটি পাঠক, শ্রোতা এবং দর্শকদের গভীর বেদনার অনুভূতিকে এমন করে আলোড়িত করে।”
রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর নাটিকাটি রচনার পেছনে একটা ইতিহাস আছে। সে সময় কবির মন সংসারের বাঁধন আর প্রাত্যহিক জীবনের গ্লানি থেকে মুক্তি অর্জনের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলো। একটা চিঠিতে তিনি লিখলেন,”আমার টাকা নেই, কাজ রয়েছে, আমার অনেক অসুবিধা, তবু আমাকে আর বদ্ধ হয়ে বসে থাকতে দিচ্ছে না, আমাকে আজ এমন করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে যে, কালের কোন প্রয়োজন, সংসারের কোন দায়িত্ব আমাকে কোনমতেই বসে থাকতে দিচ্ছে না। বেরো, বেরো, রাস্তায় বেরিয়ে পড়, আজ আমার আর অন্য কোন চিন্তা করবার জো নেই –তাই বেরিয়ে পড়বার আয়োজনে আমার একটু ক্লান্তি বা কৃপণতা নেই–মন একবারো পিছনে ফিরে তাকাতে চাইবে না।”
বিদেশের নানা স্থানে যাবার পরিকল্পনা মনে আসা সত্বেও তিনি শেষ পর্যন্ত শিলাইদহে গিয়ে নৌকোয় বসে বিশ্বভ্রমনের স্বাদ নিতে চাইলেন। শিলাইদহ তাঁর সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেছিলো :
“এখানে [শিলাইদহে] আসিবা মাত্রই আমার সেই অসহ্য ক্লান্তি ও দুর্বলতা দূর হয়ে গেছে। এমন সুগভীর আরাম আমি অনেক দিন পাইনি। এই জিনিসটি খুঁজতেই আমি দেশ-দেশান্তরে ঘুরতে চাচ্ছিলুম; কিন্তু এ যে এমন পরিপূর্ণভাবে আমার হাতের কাছেই আছে সে জীবনের ঝঞ্ঝাটে ভুলেই গিয়েছিলুম। কিছুকাল থেকে মনে হচ্ছিল মৃত্যু আমাকে তার শেষ বাণ মেরেছে এবং সংসার থেকে আমার বিদায়ের সময় এসেছে- কিন্তু যস্য ছায়ামৃতং তস্য মৃত্যুঃ,- মৃত্যুও যাঁর, অমৃতও তাঁরি ছায়া- এতদিনে আবার সেই অমৃতের পরিচয় পাচ্ছি। ” তিনি আরো লিখেছিলেন:
“যেমন করে হোক নিজের গর্তটার ভিতর থেকে নিজের নির্মল বিশুদ্ধ সত্তাটিকে বাহির করে আনতেই হবে। …মৃত্যু ভালো, কিন্তু মুক্তি চাই …খোলা রাস্তায় খোলা আলো হাওয়ায় ডাক পড়েছে…আবরণ সব জীর্ণ হয়েছে, মলিন হয়েছে, সেগুলো এবার ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাক —সর্বাঙ্গে লাগুক আকাশ।” এরকম একটা ভাবনা সাথে নিয়ে কবিগুরু আবার শান্তিনিকেতনে ফিরে এলেন। আবার তিনি বেদনা জর্জরিত হৃদয় নিয়ে লিখলেন,”আমার মনে হচ্ছিল, একটা কিছু ঘটবে, হয়তো মৃত্যু। ষ্টেশনে যেন তাড়াতাড়ি লাফিয়ে উঠতে হবে সেই রকমের একটা আনন্দ আমার মনে জাগছিল। যেন এখান হতে যাচ্ছি। বেঁচে গেলুম, এমন করে যখন ডাকছেন তখন আমার দায় নেই, কোথাও যাবার ডাক ও মৃত্যুর কথা উভয়ে মিলে, এমন একটা আবেগ, সেই চঞ্চলতাকে ভাষাতে ডাকঘরে কলম চালিয়ে প্রকাশ করলুম।”
ডাকঘরের সমালোচনা করার সময় সুধীজনদের বলতে শুনি যে, ডাকঘর একটি নাটক বটে কিন্তু এর মধ্যে নাটকত্ব নেই। কোন গল্প বা বড় কোন ঘটনা এর মধ্যে নেই। তাই এই নাটককে সোনার তরী গোছের কবিতার মতো করে লিখলেই হোতো, নাটক বলে আড়ম্বর করার কি প্রয়োজন ছিল? রবীন্দ্রনাথ নিজেও বলেছেন, “এর মধ্যে গল্প নেই, এ গদ্য লিরিক।” কিন্তু এখানে শুধু যদি একটিমাত্র ভাব থাকতো যে একটি রুগ্ন বালকের সৌন্দর্যমুগ্ধ কল্পনাপীড়িত চিত্ত বিশ্বের মধ্যে বেরিয়ে পড়ার জন্যে ব্যাকুল তবে তা গীত বা কবিতায় ব্যক্ত করা যেত সন্দেহ নেই। কিন্তু অমলের সাথে সাথে মাধব দত্ত, ঠাকুর্দা, মোড়ল, সুধা প্রভৃতি নানা অনুকূল আর প্রতিকূল চরিত্রে বৈচিত্র্যময়। তাই কবিকে এই বৈচিত্র্যসমূহের সম্মিলনে একটি স্ফটিকব্যুহ রচনা করতে হয়েছে।
মাধবদত্ত সংসারী লোক, তিনি তাঁর স্ত্রীর গ্রামসম্পর্কে ভাইপো অমলকে পোষ্য নিয়েছেন। ছেলেটি রুগ্ন। কবিরাজ তাকে শরতের রোদ আর হাওয়ার সংস্পর্শে না আসার নির্দেশ দিয়েছেন। ছেলেটি ঘরের জানালার ধারে বসে থাকে। দূরে পাহাড়ের নিচে ঝর্ণা, সেখানে পথিক একটু বিশ্রাম নিয়ে চলে যায়, মিলিয়ে যায় তার অবয়ব। এদিকে জানালার সামনে রাজপথ। দইওয়ালা সুর করে দই বেচে। সে সুরের আকর্ষণ অমলকে বিচলিত করে। তার ইচ্ছে হয় দইওয়ালার সুরটি শিখে নিয়ে একদিন সে পথে বেরোবে। ওদিকে আবার রাজার প্রহরী মধ্যাহ্নের স্তব্ধতা ভঙ্গ করে ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজায়। দূর পাহাড়, ঝরণা, ফেরিওয়ালার সুর, ঘন্টার শব্দ, শিশুদের পদচারনা, সব কিছু মিলে মিশে অমলকে আনমনা করে। একটা সুদূরের ডাক তাকে উদাস করে তোলে।
“আমি চঞ্চল হে,
আমি সুদূরের পিয়াসী!
দিন চলে যায়, আমি আনমনে
তারি আশা চেয়ে থাকি বাতায়নে!”
সুদূরের জন্যে এই ব্যাকুলতা ডাকঘরের মূলভাব।
অতি পরিচিত নিকট দৃশ্যকে নতুন করে ব্যপ্ত এক সৌন্দর্যের মধ্যে দর্শন করা ছিল কবির দৃষ্টিভঙ্গীর এক বিশেষ দিক। তাই দইওয়ালা একজন স্বতন্ত্র বিচ্ছিন্ন মানুষ নয়, তার চারদিকে কত দূরদুরান্তরের সৌন্দর্য ঘিরে থাকে। পাঁচমুড়ো পাহাড়ের সৌন্দর্য, শামলী নদীর সৌন্দর্য, লালমাটির রাস্তা, পাহাড়ের গায়ে গোচারন, ডুরে শাড়িপরা ভরা ঘট কাঁখে করে চলা গৃহবধুর দল সবই যেন দইওয়ালাকে বেষ্টন করে আছে। আর তাই সেই মিলিত সৌন্দর্য হয়ে গেছে এমন রমনীয়।
আবার ডাকঘরের অমলকে যখন দেখি সবশ্রেণির মানুষ, তাদের চলাফেরা, প্রকৃতির সব দৃশ্যের প্রতি অফুরন্ত উৎসাহ, জগতে যা কিছু দেখে তাতে তার আনন্দের সীমা নেই, তখন মনে হয় নাটকের মূল বক্তব্য হয়ত এটাই। অমলের হৃদয়ের দরজা অবারিত।
সেই ছেলেবেলায় অমলের প্রতি যখন সহানুভূতিতে মন ভরে উঠতো, ঝগড়া করতাম রবি ঠাকুরের সাথে, আজ পরিনত বয়সে জীবন সায়াহ্নেও মনে মনে উত্তর খুঁজি অমলের জানার অসীম আগ্রহ থাকা সত্বেও তাকে কেন অনন্তের মাঝে বিলীন হতে হলো? সে কি রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর প্রতি অনুরাগের কারনে? তাঁর কাছেই তো শুনেছি “মরণ রে, তুঁহু মম শ্যম সমান”। তাই কি তাঁর সেই মৃত্যুবিলাসকে তিনি রূপ দিলেন অমলের ঘুমের মাঝে?
জগতে এমন ঘটনা তো বিরল নয়। পুত্র শমীন্দ্রনাথও তো এমনি করে অসময়ে অনন্তলোকে যাত্রা করেছিলেন। তবু মানতে পারি না কবির মনের চঞ্চলতাকে ঢাকতে তিনি তাঁর কলমে অমলের অনন্ত নিদ্রায় বিলীন হয়ে যাওয়াকে তুলে ধরেছেন সহৃদয় পাঠকের সামনে। আবার এও তো সত্যি নাটকের এই করুণ উপসংহার আমাদের হৃদয় নিংড়ানো বেদনা আর অশ্রুধারায় আপ্লুত করে। তখন ইংরেজ কবি শেলির কথায় ফিরে আসতে হয়, “Our sweetest songs are those that tell of saddest thought.”
এম এ লতিফ – কবি, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ।