বই- নন্দিত নরকে
লেখক- হূমায়ুন আহমেদ
হূমায়ুন আহমেদ এর এটি প্রথম উপন্যাস।
উপন্যাসটি খুব সাধারণ একটা নিম্নবিত্ত পরিবারের জীবন সংগ্রাম নিয়ে লেখা, যে পরিবারেরই মানসিক বিকারগ্রস্ত মেয়ে রাবেয়া। রাবেয়াকে ঘিরেই পুরো গল্পের পটভূমি। এছাড়া এ গল্পে আছে মা, বাবা, ভাই, বোন, শফিক সহ অনেকেই। চার ভাই-বোনের মধ্যে বড় মেয়ে রাবেয়া বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী।
উপন্যাসের কেন্দ্রে রয়েছে এক নিম্নবিত্ত পরিবারের হাসি-কান্না ও সংগ্রাম-অসহায়ত্বের কাহিনি। উপন্যাসটি প্রথম পুরুষে লেখা।লেখক নিজেকে বেছে নেন উপন্যাসের কাহিনি কথক হিসেবে।নামও থাকে হুমায়ূন। বইটিতে কোন চরিত্রকেই প্রধান বলা যায় না।এখানে প্রধান হয়ে উঠেছে নিন্ম মধ্যবিত্তের হাসি-কান্না।এ পরিবারে সদস্য হচ্ছে মা-বাবা, তাদের সন্তান রাবেয়া ওরফে রাবু,খোকা, মন্টু আর রুনু।খোকা পড়াশুনার প্রতি মনোযোগী হওয়ায় পরিবারের সবার স্বপ্ন তাকে নিয়ে।মন্টু একটু খেয়ালি স্বভাবের।সারাদিন খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত থাকে।রাবেয়া মানসিক প্রতিবন্ধী। সে খোকার এক বছরের বড়।তাকে নিয়ে সবার অসম্ভব কষ্ট। রুনু সবার ছোট বোন। এ পরিবারের সাথে আরো থাকে আশ্রিত এক মাস্টার,খোকার বাবার বন্ধু। তারা ডাকে মাস্টার কাকা।মাস্টার কাকা আনন্দমোহন কলেজে পড়াশোনা করে রাবেয়াদের বাড়িতেই আশ্রয় নেয়। এখানেই সে দিনযাপন করে এবং রাবেয়ার ভাইবোনদের পড়ায়।
রাবেয়া ভালো-মন্দের পার্থক্য করতে পারে না। সে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ায়। একদিন রাবেয়া হারিয়ে যায়।অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাকে মাস্টার কাকা স্কুল থেকে ফেরার পথে নিয়ে আসে।এ ঘটনার কিছুদিন পর হঠাৎ চা খাওয়ার পর যখন রাবেয়া বমি করে, তখন সবাই বুঝতে পারে রাবেয়া সন্তানসম্ভবা।কেউ রাবেয়ার সর্বনাশ করেছে। পাগল মেয়ের সাথে কে কখন কী করেছে সে বলতে পারেনা। পরিবারের সদস্যরা বিভিন্নভাবে তাকে অনেককিছু জিজ্ঞেস করে।কিন্তু অসুস্থ রাবেয়া কিছুই মনে করতে পারেনা।শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। দিন অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে রাবেয়ার শারীরিক পরিবর্তন আসতে শুরু করে। হঠাৎ অবিবাহিত মেয়েটি সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়লে পরিবারটি বিপদে পড়ে।কোন একদিন ভোরবেলা নিজের ঘরেই গর্ভপাত ঘটানো হয় রাবেয়ার। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে শহর থেকে ভালো ডাক্তার আসার আগেই রাবেয়া মারা যায়।রাবেয়ার মৃত্যুর জন্য মন্টু মাস্টার কাকাকে দায়ী মনে করে এবং হাতের বটি দিয়ে আঘাত করে খুন করে।পুলিশ এসে মন্টুকে ধরে নিয়ে যায়। কী কারণে খুন করেছে ইত্যাদি অনেককিছু জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও মন্টু কিছু বলে না।আদালতের রায়ে মন্টুর ফাঁসি হয়।উপন্যাসে লেখক সমাজের অবাঞ্চিত দিক তুলে ধরেছেন। রাবেয়া প্রতিবন্ধী হলেও পরিবারের সান্নিধ্যে আনন্দে-দুঃখে কেটে যাচ্ছিল তার সময়।কিন্তু হঠাৎ থমকে যায়।
লেখক এখানে সরাসরি কাহিনি না বললেও পাঠক বুঝতে পারে মাস্টার কাকাই রাবেয়ার সর্বনাশ করেছে। মাস্টার কাকার পাশবিকতার কাছে হার মানে রাবেয়ার সবরকম উচ্ছলতা। এই অবাঞ্চিত ঘটনা গোটা পরিবারকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়। এই মাস্টার কাকা চরিত্রের মাধ্যমে সমাজে ভদ্রতার মুখোশধারী অসচ্চরিত্রের লোকদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন লেখক।
উপন্যাসের নামকরণের সাথে অভিপ্রায়ের চমৎকার মিল পরিলক্ষিত হয়।সাজানো সুখের একটি আবাস আকস্মিক মৃত্যু কীভাবে নরকে পরিণত করে দেয় তা এই উপন্যাসে ধারণ করা হয়েছে। রাবেয়ার অস্বাভাবিক মৃত্যুর আকস্মিকতাবোধ বিনষ্ট হয়েছে একটি পরিবারের মূল্যবোধ, বিশ্বাস, সুস্থতা। তাই নামকরণে তিনি পরিপূর্ণ সফল ও সার্থক শিল্পী।
‘নন্দিত নরকে’ লেখকের প্রথম দিকের উপন্যাস হলেও সাহিত্যিক বিচারে প্রশংসিত হয়েছিল এবং বিশেষজ্ঞদের মতে এটিই তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনায় দাবিদার। এ উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি বাংলা কথাসাহিত্যে নতুন দ্বার উন্মোচন করেছিলেন।
পারভীন আকতার পারু – সহ সম্পাদক, চেতনা বিডি ডটকম।